নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,




(এই নিবন্ধটি অরুণোদয়, মে, ২০১৪ সংখ্যার জন্য লিখেছেন অরূপা মহাজন। )



হিন্দুত্ববাদ ও নয়া-উদারবাদ

            জয় ও পরাজয় পরস্পর সম্পৃক্ত। এই পরিভাষায় এবারের নির্বাচনী ফলাফলকে যে কোন সাধারণ পর্যবেক্ষক বিজেপির জয় ও কংগ্রেসের পরাজয় হিসেবে চিত্রায়িত করবেন। কিন্তু সাধারণ এই বয়ানের অন্তরালে যে সামাজিক বা উৎপাদন সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস, এই সম্পর্কের সাথে জৈবিক সম্পর্কে আবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্বিন্যাস এবং সামগ্রীকভাবে রাষ্ট্রীয় ও ব্যাক্তি মালিকদের মধ্যে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের কথা থাকে তাকে গভীরে বিচার করে দেখতে হয় যাতে আগামীতে কী ঘটতে চলেছে তার একটা অনুমান লাগানো যায়।

এনডিটিভি’র এক প্যানেল আলোচনায় বরখা দত্ত প্রশ্ন করেছিলেন যে এবারের নির্বাচন কী ‘প্যারাডিগম সিফট’ সূচিত করছে? উত্তরদাতারা গতবাঁধা উত্তরের মধ্যেই নিজেদের আঁটকে রাখেন। কিন্তু একটু ভাল করে বিচার করলেই দেখা যাবে যে দ্বন্দ্বের মীমাংসার প্রয়াস বাজপেয়ী আমল থেকে শুরু হয়েছিল, মোদীর নেতৃত্বের মাধ্যমে সেই দ্বন্দ্বের মীমাংসার বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। কী ছিল সেই দ্বন্দ্ব? সেটা ছিল হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের সাথে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি প্রণয়নের দ্বন্দ্ব। এবার এই সুযোগ কীভাবে উপস্থিত হলো, কেন এবার তার বাস্তবায়ন সম্ভব হলো এবং ভারতীয় জনতার জন্য এটা কী বার্তা বহন করে আনল এসব সবিস্তারে অধ্যয়ন করা, নিজেদের ভূমিকার পর্যালোচনা করা এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বামপন্থী ও গণতান্ত্রিকদের কাছে জরুরি কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে। এব্যাপারে খানিকটা আলোকপাত করার প্রচেষ্টা নেওয়ার আগে পরাজিতদের অভ্যন্তরে মীমাংসা করতে ব্যার্থ হওয়া সংঘাতের বিষয়টি দেখা যাক।

ইউপিএ’র অভ্যন্তরিণ সংঘাত

            কংগ্রেসের অভ্যন্তরিণ এই সংঘাতটি ইউপিএ ওয়ানের আমলে এতো প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি, কারণ নয়া-উদারবাদী অর্থনীতিকে সবাই তখন মেনে নিয়েছিলেম এবং প্রথম দফার সংস্কার কর্মসূচীর সুফলের প্রাথমিক স্পর্শ পেয়ে নতুন মধ্যশ্রেণি এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই তাদের ইপ্সিত আকাঙ্খা পূরণের স্বপ্ন দেখছিলেন। তাই ইউপিএ ওয়ানের প্রশংসা শুধু কর্পোরেট দুনিয়া নয়, খুদ বিজেপিও প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেনি। কংগ্রেস-বিজেপি সহযোগিতার পরিবেশে বামপন্থীদেরও ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। কিন্তু ইউপিএ ওয়ানের শেষের দিকে নয়া-উদারবাদী নীতির কুফলগুলি জনসমক্ষে আসতে শুরু করল। সামাজিক অসাম্য বাড়তে থাকল লাফিয়ে লাফিয়ে, বিকাশের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে থাকল, দারিদ্র্য-বেকারত্ব-শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার অভাব-কৃষির ও খাদ্য উৎপাদনের বিপর্যয়ের স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকল। বিদেশি ফিনান্স পুঁজির ফাটকা বিনিয়োগ ও জল-জমি-জঙ্গল লুট করে সেজ-এলাকার সুবিধা ভোগ করে বহুজাতিক পুঁজির অতি-মুনাফাই যে আসলে এই বিকাশের আসল রহস্য তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকল গণ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। এই প্রতিবাদ-বিদ্রোহের চাপেই কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে একটি অংশ রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে সরব হয়ে উঠল। দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, অভ্যন্তরিণ বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলো। কিন্তু ইউপিএ ওয়ানের শেষের দিকে ও ইউপিএ দুইয়ে গৃহীত এই পদক্ষেপগুলি কর্পোরেট দুনিয়াকে অসন্তুষ্ট করে তুলল। বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকটকালে শ্রমের জন্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে অধিক ব্যয় তাদের মুনাফার হারকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। কর্পোরেট দুনিয়ার অসন্তোষকে দূর করার জন্য সরকার নয়া-উদারবাদী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখল, দেশের সম্পদ তাদের লুটের জন্য খুলে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হলো যথেচ্ছভাবে। কিন্তু রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকাকে নস্যাৎ করে দিয়ে দ্বীতিয় প্রজন্মের সংস্কারের জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার আকাঙ্খার বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা বিনিয়োগে উৎসাহ বোধ করল না। রপ্তানী বাণিজ্য, শেয়ার-বাজার, মুদ্রা-বাজারের অবনমন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি বাণিজ্য নীতিকে অবাধ করে দিয়ে ও ইন্টারেস্ট রেট রিজিমের মাধ্যমে মানি-সাপ্লাইকে নিয়ন্ত্রণ করে রোখা যায় না, কিন্তু কংগ্রেস সরকার বিকল্প কোন পথ মাড়ালই না। অন্যদিকে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে দরিদ্র গ্রামীণ মানুষ ও অসংগঠিত শ্রমিকের মন জয়ের কংগ্রেসি প্রচেষ্টাও সফলতার মুখ দেখল না। কারণ কল্যাণকামী ব্যবস্থাগুলি কায়েম করতে যে সরকারি কোষাগার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করার জন্য বিকল্প কোন শিল্প-নীতির পথ তাঁরা অবলম্বন করল না এবং যেটুকু অর্থ সেক্ষেত্রে বরাদ্দ হলো তাও লুটেপুটে খেয়ে নিল দুর্নীতিবাজ কংগ্রেসি দলতন্ত্র ও তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনযন্ত্র।

কংগ্রেসি দোলাচল ও বামপন্থীদের ভূমিকা
             অনগ্রসর একটি দেশে মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা সাধারণতঃ দৈহিক শ্রমের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের সাথে ঐক্য স্থাপনের জন্য নিজে থেকেই মতাদর্শগতভাবে আগ্রহী হয়ে উঠে না। বামপন্থী মতাদর্শের যেটুকু প্রভাব পূর্বে ছিল তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তাই মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত পুরোনো পাবলিক সেক্টরের অবশিষ্টাংস, তথ্য-প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত খণ্ডের সাথে যুক্ত নতুন এই শ্রেণি এবং যারা মানসিক শ্রমের বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সেই শিক্ষিত শ্রেণির বৃহৎ অংশ (একাংশকে আম-আদমি পার্টি কিছু জায়গা করে দিতে পেরেছিল) সমস্যার চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী এক সমাধানের এক কল্পিত আলেয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। অথচ তারা সামাজিক কল্যাণের এক গঠনমূলক পথের দিকে আকৃষ্ট হতে পারত যদি অভ্যন্তরিণ বাজারকে সচল করা, দেশীয় উদ্যোগ ও পাবলিক সেক্টরকে সচল করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, ভূমি সংস্কার-কৃষির আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের পরিকল্পনা ও বৃহৎ পুঁজিপতিদের আয়ের উপর করের বোঝা চাপিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার নির্মাণ ইত্যাদি পদক্ষেপের দিকে সরকার হাঁটত। এক্ষেত্রে নয়া-উদারবাদী নীতিকে পুরোপুরি বিরোধিতা করতে হত। নয়া-উদারবাদ ও কল্যাণকামী এক রাষ্ট্রীয় নীতি – এই দুয়ের মাঝামাঝি এক পথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কংগ্রেসি সরকার না সন্তুষ্ট করতে পারল কর্পোরেট দুনিয়াকে, না দরিদ্র গ্রামীণ মানুষের মন জয় করতে পারল। আজকের বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকটকালে ও কেইন্সীয় অর্থনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার সময়ে এধরণের ভারসাম্য বজায় রাখার পন্থা সফলতার মুখ দেখতে পারে না। আর শিক্ষিত বেতনভোগী শ্রেণি ও শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি যখন অন্যপথে হাঁটে, তখন অসংগঠিত গরিব কায়িক শ্রমজীবী ও কৃষকদেরকেও তাদের সাথে টেনে নিয়ে যায়। সংসদীয় বামপন্থীরাও ভারতবর্ষের বিভিন্ন পেশার মানুষদের ও সামাজিক আন্দোলনগুলিকে একত্রিত করে ব্যাপক মঞ্চ তৈরি করার প্রয়াস নেননি, যেখানে তাদের আকাঙ্খা ও ক্ষোভের এক বাম-মতাদর্শগত সমাধানের পথের সন্ধান তারা করতে পারে। এক্ষেত্রে আম-আদমি পার্টির ভূমিকা বরঞ্চ প্রশংসনীয়। এই মতাদর্শগত শূন্যতার পরিস্থিতিতে বিত্ত পুঁজি, বণিক পুঁজি ও তাদের সহযোগী     শিল্প-মালিক ও কৃষি এলিটদের জোট উপরুল্লিখিত দুটি শ্রেণি ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং এরফলেই ভারতীয় রাজনীতিতে ঘটে এক চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী উত্থান। তাদের অর্থে ও এই শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকদের সহায়তায় গড়ে তোলা হয় প্রচারের এমন এক অভূতপূর্ব মায়াজাল যাকে ভেদ করে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি কারুর। এখানেই এই উত্থানের কাহিনীর শেষ নয়। এর পেছনে আরও কিছু বৈশষ্ট্য রয়েছে।

প্রতিবন্ধকতার মোহ ও দক্ষিণপন্থী সাংগঠনিক বিস্তার

             চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী উত্থানের প্রশ্নে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ও ব্যাক্তিরা একধরনের আত্মসন্তুষ্টিতে আক্রান্ত ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল যে ভারতীয় বৈচিত্র, মণ্ডল রাজনীতি, দলিত উত্থান এগুলির জন্য ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়াবে না। বাস্তবে এই প্রতিবন্ধকতাগুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বহুদিন ধরে প্রতিহত করেও আসছিল। কিন্তু আর্থিক-সামাজিক চূড়ান্ত সংকটের সময় ও মানুষের আকাঙ্খা বৃদ্ধির ঊষালগ্নে বিকল্প কোন গণতান্ত্রিক পথের সন্ধান ছাড়া সমাধানের উগ্র-ভাবনার বিষম উন্নয়নের কল্পিত রূপের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়। তাই ফিনান্স পুঁজি, বণিক পুঁজি ও কৃষি-এলিটরা বিহার উত্তরপ্রদেশের অতি-দলিত ও অতি-অবিসিদেরও তাদের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিহারে যদিও লালু যাদবের নেতৃত্বে যাদব-মুসলিম ঐক্য গড়ে উঠেছিল, উত্তর প্রদেশে মুজাফফর নগর দাঙ্গায় ইউপি সরকারের নেক্কারজনক ভূমিকার ফলে যাদব ভোটও এসপি’র ছত্রছায়া ত্যাগ করে বিজেপির কোলে আশ্রয় নেয়। উপরন্তু সাম্প্রদায়িক এক বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো যে ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে গড়ে উঠেছে এব্যাপারটাকেও সবাই খাটো করে দেখেছেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষি বিপর্যয়, উত্তর প্রদেশের মুজাফফর নগরের দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবারের মতাদর্শগত প্রচার সামাজিক ঐক্যের বিন্যাসে যে নতুন এক সমীকরণ গড়ে তুলেছে এদিকে কারুর দৃষ্টি পড়েছে বলে মনে হয় না। তবে যেসব রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি সক্রিয় রয়েছে সেইসব রাজ্যে সংঘ পরিবার খুব বেশি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আঞ্চলিক বুর্জোয়ারা কতদূর নয়া-উদারবাদের সাথে সমঝোতা বা বিরোধিতা করতে প্রস্তুত সে বিষয়টি যাচাই করে দেখা উচিত। আনন্দবাজারের মত গোষ্ঠীদের এই প্রক্রিয়ায় একটা ভারসাম্য রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বাম-গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও তামিল জাতিয়তাবাদী চেতনা ও দলিত আন্দোলনের ঐতিহ্য এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করেছে কিনা সেটাও বিচার্য। মমতার মুসলিম ভোট পাওয়ার বাধ্যবাধকতা ও জয়লিলতার এধরনের বাধ্যবাধকতা না থাকাই তাদের অবস্থানের একমাত্র কারণ কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয়।

জার্মানীর ইতিহাসের সাযুজ্য
            মোটামুটিভাবে প্রায় একই কালসীমায় ইতিহাসের কোন ঘটনার যখন পুনরাবৃত্তি ঘটে, তখন সাযুজ্য ও তূলনামূলক বিচারের পদ্ধতি সীমিত ক্ষেত্রে হলেও কিছু পথের সন্ধান দেয়। ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে জার্মানীর পুঁজিবাদের বিকাশ শুরু হয়েছিল কিছুটা বিলম্বে। পুঁজিবাদের বিকাশ এবং তার অপূর্ণতা ও দুর্বলতা, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দুর্বলতা, পুঁজির ও সামাজিক শ্রেণির এবং ওয়েমার সংসদীয় ব্যবস্থার সংকট ইত্যাদি হিটলারের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক উগ্র-জাতিয়তাবাদের দিকে জনগণকে আকৃষ্ট করতে ও ফ্যাসিস্ট উত্থানে গণ-সমর্থন লাভে নাজি পার্টিকে সফলতা প্রদান করেছিল। ওয়েমার গণতন্ত্রের জার্মানে ১৯৩০ অব্দি মোটামুটিভাবে ভারী-শিল্প মালিকদের ও সংগঠিত শ্রমিকদের এক কোয়ালিশন বজায় ছিল। এই কোয়ালিশন তৈরি হয়েছিল পুঁজিবাদী গঠন প্রক্রিয়ার অগ্রগতির সময়ে এস্টেট মালিক বা কৃষি এলিটদের সাথে পুঁজির দ্বন্দ্বকে প্রাধাণ্য দিয়ে। ক্ষমতার অংশীদারী হয়ে সংগঠিত শ্রমিকের দরকষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকের মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, চাকরির স্থায়ীত্ব ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ১৯১৪ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে যুদ্ধ ও বিপ্লবের প্রেক্ষিতেই পুঁজির সংকটের পর্যায় শুরু হয়। ফলে শ্রমের জন্য ব্যয় বৃদ্ধির ফলে শিল্প-পুঁজিপতিদের মুনাফা কমে যাওয়াকে তারা মেনে নিতে পারেনি এবং তারা এস্টেট-মালিক তথা কৃষি-এলিট ও ব্যাঙ্কারদের সাথে আঁতাত করে শ্রমের বিরোধিতায় নেমে পড়ে। এই আঁতাত গড়ে উঠে রপ্তানী শিল্পের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করে কৃষি এলিট ও ফিনান্স পুঁজির জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়ে। এই জোট উগ্র সাংস্কৃতিক জাতিয়তবাদী আবেদনের মাধ্যমে মধ্যশ্রেণি, পেটি-বুর্জোয়া, বেতনভোগী সবাইকে নিজেদের পক্ষে টেনে নেয়। ১৯৩৫ সালের পপুলার ফ্রন্টের ধারণার আগে পর্যন্ত বামপন্থীরা শ্রমিক শ্রেণির বাইরে কর্মচারী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, পেনশনার, প্রফেশনাল, গ্রাহক, নাগরিক, করদাতা, কৃষক ইত্যাদি সমাজের প্রতিটি অংশের উদ্দেশ্যে বাম-মতাদর্শের ছত্রছায়ায় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে কোন ব্যাপক জোট গড়ে তোলার আবেদন জানায়নি ও প্রচেষ্টা নেয়নি। উৎপাদনী সম্পর্ক বা সামাজিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণের সময়ে বামপন্থীরা পেটি-বুর্জোয়া এবং শাসক শ্রেণির সাথে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি এই ফ্যাসীবাদীকরণে সহায়তা করেছে। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (এনএসডিএপি), যাদের মূল সমর্থন ভিত্তি ছিল পেটি-বুর্জোয়াদের মধ্যে, সমাজের সব অংশ এমনকি মজুরি-শ্রমিকদেরকেও তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে নেয় এবং তারা একাজটি করে সমাজবাদ-সাম্যবাদ বিরোধী এক উগ্র-জাতিয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জাগরণের আহ্বানে। তাদের এই উত্থান ঘটে ওয়েমার সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে তাকে ভেঙে দেওয়ার মনোবাসনা নিয়ে। পরস্পর বিপরীত আকাঙ্খার বিভিন্ন শ্রেণির সমর্থন আদায় করেও হিটলার ও নাজি নেতৃত্ব এলিট শ্রেণিকে আস্বস্ত করতে সমর্থ হন যে ব্যবস্থার সংকটকালে তারাই এলিট স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে সক্ষম এবং নাজি পার্টির ক্ষমতায় আরোহণের ক্ষেত্রে এলিট-ফাণ্ডেড ব্যাপক মিডিয়া প্রচার তাদেরকে সহায়তা করেছিল। হিটলারি ফ্যাসিস্ট উত্থানের সাথে ১৯৩০-৩২ সালের ব্রুনিং ও পাপেনের কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পৃথক করে না দেখার মাশুল গুণতে হয়েছে জার্মান কম্যুনিষ্টদের। হিটলারের জমানায় ওয়েমার-জার্মানীর ফ্যাসিবাদীকরণের বাকী ইতিহাস সম্পর্কে সবাই অবগত। গোটা জার্মানী জাতি এখনও হিটলারি রাজত্বের কথা স্মরণ করে লজ্জায় অবনত।

রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণের সম্ভাবনা ও তার প্রতিকার
              ভারতবর্ষে যখন সাংস্কৃতিক উগ্র-জাতিয়তাবাদ কর্পোরেট দুনিয়ার খোলাখুলি মদতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন বিশ্ব ফিনান্স পুঁজি শিল্প-পুঁজির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলেছে। বর্তমান ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থা্র ডামাডোল, ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা ও পুঁজিবাদের সংকটে ত্রস্ত এলিট-শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনায় ত্রাতা হিসেবে তাদের উপরই বাজি রেখেছে। সুতরাং এই নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সংঘ পরিবারের উগ্র-জাতিয়তাবাদকে মোদী সরকার কী করে সামলায় এটা নিশ্চয়ই দেখার বিষয়। কারণ সংঘ পরিবারের অভ্যন্তরে স্তিমিত হয়ে যাওয়া জাতীয় অর্থনীতির প্রবক্তারা অনুকুল পরিস্থিতিতে মুখ খোলার চেষ্টা করতেও পারেন। সংসদকে কম গুরুত্ত্ব দিয়ে এক্সিকিউটিভ সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ চালাতে গেলে ভাজপার অভ্যন্তরে অনেককেই অসন্তুষ্ট করবে, সেই অসন্তুষ্টিকে কীভাবে প্রশমিত করা হয় সেটাও দেখার। “লেস গভার্ণমেন্ট, মোর গভার্ণন্যান্স” শ্লোগানের অন্তরালে দরিদ্র্য ও সংবেদনশীল জনসমষ্ঠীকে ভর্তুকি প্রদানের মত রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকা ক্রমান্বয়ে তুলে দেওয়ার এলিট-শ্রেণির ইচ্ছা রূপায়ণে রাজ্যসভার বাধা অতিক্রম করতে কীধরনের সংসদীয় রীতি-বিরুদ্ধ প্রথা ব্যবহার করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে এটাও লক্ষ্যণীয়। উপরন্তু ভারতীয় সভ্যতা, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অঞ্চলের আকাঙ্খাকে মোদীর নেতৃত্বে সংঘ-পরিবারের প্রকল্প কীভাবে মোকাবিলা করে সেটাও দেখার বিষয়। এই সবগুলি নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্রকে পদদলিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণের জন্য অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতা নয়, বিশেষ করে সেই পরিস্থিতিতে যখন নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। এই প্রয়োজনের বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যদি প্রতিটি সংসদীয় দল নিজেদের আর্থ-সামাজিক নীতির পুনর্মূল্যায়ন করে এবং গণমুখী সাংগঠনিক পুনর্গঠন করে। কংগ্রেসকেও এই পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে, কারণ তাদের বর্তমান শক্তি থেকে উঠে আসার জন্য মোদীর দেখানো পথ খুব একটা সহায় করবে না, কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে নয়া-উদারবাদী পথের মোহ থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষণ এই অভূতপূর্ব হারের পরও দেখা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সংসদীয় ও অন্যান্য বাম দল, আম আদমি পার্টি, প্রকৃত বামপন্থীরা, কিছু পরিমাণে আঞ্চলিক ও জনগোষ্ঠীগত শক্তিগুলি। কিন্তু এই ভূমিকার আসল সূত্র লুকিয়ে আছে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন ও বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনগুলির শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্যে এবং তাই প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজকর্মী ও বামপন্থীদের একাজে গুরুত্ত্ব সহকারে হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং তার উপর ভিত্তি করেই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পরিস্থিতির এধরনের ক্রমবিকাশ ঘটলে জার্মানীর মতন আমাদের রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণ দেখতে নাও হতে পারে কিংবা ফ্যাসীবাদ ক্ষণস্থায়ী ও সীমিত হতে পারে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে লজ্জাবনত হতে না হতে পারে। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে উৎপাদন বা আর্থিক সম্পর্ক রাজনীতিকে নির্ধারণ করে, আবার রাজনীতি উৎপাদন সম্পর্ককে প্রভাবিত করে যার মধ্যে মতাদর্শগত প্রশ্নটি গুরুত্ত্বপূর্ণ। একে কোন একমাত্রিকভাবে নির্ধারিত বিষয় হিসেবে হিসেবে দেখা ঠিক নয়।

আসামের নির্বাচনী ফলাফলের বৈশিষ্ট্য

               অরুণোদয় পত্রিকা যেহেতু আসাম রাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়, তাই আসাম সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া উচিত। আসাম নির্বাচনের ফলাফলের ক্ষেত্রে নিম্ন আসাম ও বরাক উপত্যকার নির্বাচনী ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্ন আসাম বিশেষ করে কোকরাঝাড় নির্বাচন চক্রে নির্দল অ-বড়ো প্রার্থীর সাড়ে তিন লাখেরও অধিক ভোটে বিজয় এটাই প্রমাণ করে যে অকুতোভয়ে অ-বড়ো সব সম্প্রদায়ের মানুষ ভোট দিয়েছেন এবং তাতে বড়ো উগ্রজাতিয়তাবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের পিছু হটতে বাধ্য করবে এবং বড়োদের মধ্য থেকে ক্ষীণ হলেও গণতান্ত্রিক আওয়াজ উঠে আসার সুযোগ তৈরি হবে। এই পরিস্থিতিতে সব জনগোষ্ঠীর এক ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়ে উঠার পথ প্রশস্ত হবে। বরাক উপত্যকার দুটি নির্বাচন চক্রের ফলাফল এটাই দেখায় যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে, তখন বরাকের দুটি কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল গণতান্ত্রিক পর্যবেক্ষকদেরকে আশান্বিত করেছে। করিমগঞ্জের এইউডিএফ প্রার্থীর লক্ষাধিক ভোটে জয় এটাই দেখায় যে সেখানে মুসলিম ও নমঃশূদ্র ভোট এককাট্টা হয়েছে এবং বিজয়ী প্রার্থীর অন্যান্য সম্প্রাদায়েরও ভোট প্রাপ্তি ঘটেছে। শিলচর নির্বাচন চক্রে এইউডিএফ প্রার্থীর লক্ষাধিক ভোট প্রাপ্তি সত্ত্বেও পয়ত্রিশ হাজারেরও অধিক ভোটে কংগ্রেস প্রার্থীর জয় থেকে বোঝা যায় যে মুসলিম ও চা-শ্রমিক ভোট ছাড়াও বিজয়ী প্রার্থীর অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভোট প্রাপ্তি ঘটেছে। শিলচরে এইউডিএফ-এর প্রাক্তণ কংগ্রেসী মুসলিম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট এইউডিএফ-এর সমর্থকদের ভোট না কংগ্রেসী স্যাবোতাজজনিত ভোট এব্যাপারে পর্যবেক্ষকরা সন্দিহান। এব্যাপারে অনেকেরই মত এই যে এইউডিএফের প্রাপ্ত ভোট আসলে কংগ্রেসী ভোট, এইউডিএফের ভোট নয় এবং এইউডিএফের ভোট কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষে গেছে। উভয় নির্বাচনী চক্রে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বরাক উপত্যকার নির্বাচনে সে অর্থে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটেনি। নিম্ন আসাম ও বরাক উপত্যকার নির্বাচনী ফলাফল গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনরুত্থানের জন্য আশাব্যঞ্জক।  

নরেন্দ্র মোদীর প্রধান মন্ত্রী রূপে রাজ-অভিষেকের পর ‘নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য’ এই মূল নিবন্ধে সংযোজন ঃ
২৬ মে ঘটা করে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। এবারের এই অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ ছিল মালদ্বীপ সহ সার্ক দেশসমূহের উপস্থিতি। পাকিস্তানের উজিরে আজম নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি ও দুই রাষ্ট্র-প্রধানের মধ্যে নিভৃতে বার্তালাপ সবচাইতে বেশি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। এই সরকারের আসল এজেণ্ডা যে উন্নয়ন এবং সার্ক দেশসমূহের অভ্যন্তরিণ বানিজ্যের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করার জন্যই এই প্রয়াস তাতে আর অনেক বিশেষজ্ঞদেরই কোন সন্দেহ রইল না। বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধণ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে যে জটিল বিষয়গুলি রয়েছে তার মীমাংসার পথে যেন হাঁটে বর্তমান সরকার এটাই ছিল এলিট শ্রেণির আকাঙ্খা। কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশের সাথে এভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার রণকৌশলে ভাজপার কোর-কনস্টিট্যুয়েন্সি তো সন্তুষ্ট হতে পারে না। তাই এই মহা-সমারোহের পর চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই প্রধাণমন্ত্রী দপ্তরের রাজ্য-মন্ত্রী উস্কে দিলেন ৩৭০ ধারা নিয়ে বিতর্ক এবং তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলো আরএসএস-এর সদর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রী ফেডারেল কাঠামোকে শক্তিশালী করার কথা বলে জয়ললিতাদের বার্তা পাঠালেন বটে, কিন্তু সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে তাঁর রাজ্য মন্ত্রীর চটজলদি মন্তব্যের ব্যাপারে কিছু বললেন না। অন্যদিকে এই সরকারের শুরুয়াতটাও হয়েছে অর্ডিন্যান্সের মত একটি হাতিয়ার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যা গণতান্ত্রিকদের আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। কালো টাকার সন্ধান ও উদ্ধার নব-গঠিত কমিশনের তদন্তের দায়রা থেকে কতটুকু বেরোতে পারবে তা এখনো সন্দেহের আবর্তে, কারণ এক্ষেত্রে আমেরিকানদের স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এবং পূর্বতন সরকারও কালো টাকার সন্ধানে অনেক কুনাট্য করেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ভারসাম্যের খেলা কিছুদিন চলতে থাকবে, অন্ততঃ বিভিন্ন রাজ্যের আশু নির্বাচনগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো বটেই। আমাদের সংস্কারমুখী অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণাই করে দিয়েছেন যে রপ্তানী বৃদ্ধি করে জটিল আর্থিক পরিস্থিতিকে সামলানো ও বিকাশের হার বৃদ্ধি করাই তাঁর প্রাথমিকতা। রপ্তানী নির্ভর বিকাশ যে বিশ্ব বিত্ত পুঁজি ও বণিক পুঁজির কাছে সবচাইতে বেশি কাম্য এখন আর তা খোলসা করে কাউকে বোঝাতে হয় না। বর্তমান বিশ্বে বিত্ত পুঁজির নিয়ন্ত্রক আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট। সুতরাং সার্ক দেশসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমেরিকান প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে ও দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে স্বল্প সময়ের জন্য নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যে আমেরিকা তার আর্থিক অবস্থাকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপীয় দেশসমূহকে ক্ষতিপূরণের দায় জার্মানীর উপর চাপিয়ে দিয়ে যে ভার্সাই চুক্তি হলো, তাতে জার্মানী আমেরিকার কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হলো এবং জার্মান পুঁজিবাদ রপ্তানীভিত্তিক উৎপাদনের উপর গুরুত্ত্ব আরপ করতে গিয়ে চাহিদা মেটাতে বাস্তবে প্রভূত আমদানী বৃদ্ধি ঘটালো এবং ধারের জন্য উত্তরোত্তর আমেরিকান ব্যাঙ্কারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ভিন্ন প্রেক্ষিতে অনুরূপ ব্যালেন্স অব ক্রাইসিসের মধ্যে ১৯৯০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে মনমোহন সিংহকে কাঠামোগত পুনর্গঠনের নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি চালু করতে হয়েছিল। আমেরিকান বিত্ত পুঁজির উপর নির্ভরশীল জার্মানী তথা ইউরোপীয় দেশসমূহ এই ঋণ-কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারল না। তীব্র বেকারত্ব ও জনগণের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া যে চাহিদার সংকট তৈরি করল তাতে উৎপাদনী বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে এবং আমেরিকার ধার দেওয়ার ক্ষমতাকেও সংকুচিত করে ফেলল। এই সংকটের চূড়ান্ত পড়িনতি ১৯২৯ সালের শেয়ার বাজার পতন ও মহামন্দার শুরুয়াত। বিত্ত-পুঁজি নির্ভর বিকাশের এই ইউরোপীয় প্রজেক্টের বাইরে রইল একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া যারা বিপ্লবোত্তর পরিকল্পনা-অর্থনীতির পথে হাঁটছিল। পুঁজিবাদের এই সংকট ও ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লবের পর গোটা ইউরোপে আন্দোলনমুখর শ্রমিক শ্রেণি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির বিকাশের বাস্তবতায় গড়ে উঠল পুঁজি-শ্রমের সমঝোতার নিউ-ডিল। ইউরোপের পুঁজিবাদের পুনরায় জেগে উঠা নির্ভর করছিল জার্মান অর্থনীতির সুস্থিরতা ও বিকাশের উপর। জার্মানীর বাস্তবতার অতি-মূল্যায়ন করে কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিল যে জার্মানীতে বিপ্লব হয়ে যাবে ও শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে নেবে এবং তাদের এই অত্যুৎসাহের ফলেই কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজ-গণতন্ত্রীদের সাথেও ঐক্য স্থাপন করার কথা ভাবল না। এই সুযোগেই ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হলো ও হিটলারের বিশ্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। জার্মানীতেই এই প্রক্রিয়া গড়ে উঠার পেছনে সম্ভবত আরেকটি কারণ ছিল। ফরাসী বিপ্লব যেভাবে ফরাসীদের মনোজগতে লিবারেল-ডেমোক্রেসীর মূল্যবোধ গড়ে তুলেছিল, জার্মানীতে সেরকম কোন ঐতিহ্য ছিল না। যাইহউক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে স্বল্প সময়ের জন্য আমেরিকার অংশগ্রহণ অন্যান্য দেশের তূলনায় আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত করে রাখল এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ধার প্রদানের জন্য আমেরিকা বিত্ত পুঁজির প্রধান কেন্দ্র হয়ে রইল। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ও সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কোন একক শক্তি আর রইল না। কিন্তু মুনাফা ও সঞ্চয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুজিবাদের দীর্ঘম্যাদী সংকট আবারও তৈরি হয়েছে সত্তরের দশকে। সুতরাং আরেকটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করার পথে হাঁটছে বিশ্ব-পুঁজিবাদ। এই পর্যায়ে মতাদর্শগত স্তরে সোভিয়েত রাশিয়ার মত কোন কম্যুনিস্ট বিকল্পের ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে না। তবে ভোগ্যপণ্যের ও মিলিটারী উৎপাদনী মেশিনকে চালু রাখার জন্য আমেরিকান বিশ্ব-আধিপত্যের আর্থিক ও সামরিক কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদর্শন শুরু হয়ে গেছে। আর্থিক দিক দিয়ে চিন এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, ভাঙনের পরও রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতা অটুট। চিন সমুদ্র উপকূলে শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাশিয়া ও চিন যৌথ মহড়ায় অবতীর্ণ হয়েছে, ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিয়েছে যে রাশিয়া তাদের রণকৌশলগত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই ছেড়ে দেবে না। ২০০৮ সালের শেয়ার বাজার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ক্ষমতাও দুর্বল হয়েছে। মোদী সরকার ও অন্যান্য সার্ক দেশগুলি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির এই দ্বিবিধ শক্তির রণকৌশলগত খেলায় কী বিদেশ নীতি অবলম্বন করে এটাও দেখার বিষয়। তবে বিশ্ব-পুঁজিবাদের এই সংকটময়কালে সীমিত যুদ্ধ, ফ্যাসীবাদী উত্থান ও তার বিপরীতে মেহনতি মানুষের আন্দোলনমুখী উত্থান যে এক বাস্তব পরিস্থিতি হিসেবে দেখা দিয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ-ফ্যাসীবাদ-ধ্বংস না গণতন্ত্র-সাম্যবাদ-সৃষ্টির পক্ষে বিকশিত হবে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ও রণনীতিগত পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং একাজটি করতে হবে মানবতা ও মানব সভ্যতার স্বার্থেই। ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিপর্যয় ও যুদ্ধ সামগ্রীর সম্ভার মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঐক্য, সৌভাতৃত্ব ও সাম্যের শ্লোগান আবারও বিশ্ব-মানবের আঙ্গিনায় মুখরিত হোক – এটাই কাম্য।         
   

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

(ইউনিকোডে যারা পড়তে পারবেন না, তাদের জন্যে ছবিতে রইল নিচে)               








0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন