নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,




(এই নিবন্ধটি অরুণোদয়, মে, ২০১৪ সংখ্যার জন্য লিখেছেন অরূপা মহাজন। )



হিন্দুত্ববাদ ও নয়া-উদারবাদ

            জয় ও পরাজয় পরস্পর সম্পৃক্ত। এই পরিভাষায় এবারের নির্বাচনী ফলাফলকে যে কোন সাধারণ পর্যবেক্ষক বিজেপির জয় ও কংগ্রেসের পরাজয় হিসেবে চিত্রায়িত করবেন। কিন্তু সাধারণ এই বয়ানের অন্তরালে যে সামাজিক বা উৎপাদন সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস, এই সম্পর্কের সাথে জৈবিক সম্পর্কে আবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পুনর্বিন্যাস এবং সামগ্রীকভাবে রাষ্ট্রীয় ও ব্যাক্তি মালিকদের মধ্যে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের কথা থাকে তাকে গভীরে বিচার করে দেখতে হয় যাতে আগামীতে কী ঘটতে চলেছে তার একটা অনুমান লাগানো যায়।

এনডিটিভি’র এক প্যানেল আলোচনায় বরখা দত্ত প্রশ্ন করেছিলেন যে এবারের নির্বাচন কী ‘প্যারাডিগম সিফট’ সূচিত করছে? উত্তরদাতারা গতবাঁধা উত্তরের মধ্যেই নিজেদের আঁটকে রাখেন। কিন্তু একটু ভাল করে বিচার করলেই দেখা যাবে যে দ্বন্দ্বের মীমাংসার প্রয়াস বাজপেয়ী আমল থেকে শুরু হয়েছিল, মোদীর নেতৃত্বের মাধ্যমে সেই দ্বন্দ্বের মীমাংসার বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো। কী ছিল সেই দ্বন্দ্ব? সেটা ছিল হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের সাথে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি প্রণয়নের দ্বন্দ্ব। এবার এই সুযোগ কীভাবে উপস্থিত হলো, কেন এবার তার বাস্তবায়ন সম্ভব হলো এবং ভারতীয় জনতার জন্য এটা কী বার্তা বহন করে আনল এসব সবিস্তারে অধ্যয়ন করা, নিজেদের ভূমিকার পর্যালোচনা করা এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বামপন্থী ও গণতান্ত্রিকদের কাছে জরুরি কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে। এব্যাপারে খানিকটা আলোকপাত করার প্রচেষ্টা নেওয়ার আগে পরাজিতদের অভ্যন্তরে মীমাংসা করতে ব্যার্থ হওয়া সংঘাতের বিষয়টি দেখা যাক।

ইউপিএ’র অভ্যন্তরিণ সংঘাত

            কংগ্রেসের অভ্যন্তরিণ এই সংঘাতটি ইউপিএ ওয়ানের আমলে এতো প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি, কারণ নয়া-উদারবাদী অর্থনীতিকে সবাই তখন মেনে নিয়েছিলেম এবং প্রথম দফার সংস্কার কর্মসূচীর সুফলের প্রাথমিক স্পর্শ পেয়ে নতুন মধ্যশ্রেণি এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই তাদের ইপ্সিত আকাঙ্খা পূরণের স্বপ্ন দেখছিলেন। তাই ইউপিএ ওয়ানের প্রশংসা শুধু কর্পোরেট দুনিয়া নয়, খুদ বিজেপিও প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেনি। কংগ্রেস-বিজেপি সহযোগিতার পরিবেশে বামপন্থীদেরও ইউপিএ থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। কিন্তু ইউপিএ ওয়ানের শেষের দিকে নয়া-উদারবাদী নীতির কুফলগুলি জনসমক্ষে আসতে শুরু করল। সামাজিক অসাম্য বাড়তে থাকল লাফিয়ে লাফিয়ে, বিকাশের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে থাকল, দারিদ্র্য-বেকারত্ব-শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার অভাব-কৃষির ও খাদ্য উৎপাদনের বিপর্যয়ের স্বরূপ উন্মোচিত হতে থাকল। বিদেশি ফিনান্স পুঁজির ফাটকা বিনিয়োগ ও জল-জমি-জঙ্গল লুট করে সেজ-এলাকার সুবিধা ভোগ করে বহুজাতিক পুঁজির অতি-মুনাফাই যে আসলে এই বিকাশের আসল রহস্য তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকল গণ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। এই প্রতিবাদ-বিদ্রোহের চাপেই কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে একটি অংশ রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে সরব হয়ে উঠল। দারিদ্র্য দূরীকরণ, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, অভ্যন্তরিণ বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি, শ্রমিকের মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলো। কিন্তু ইউপিএ ওয়ানের শেষের দিকে ও ইউপিএ দুইয়ে গৃহীত এই পদক্ষেপগুলি কর্পোরেট দুনিয়াকে অসন্তুষ্ট করে তুলল। বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকটকালে শ্রমের জন্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে অধিক ব্যয় তাদের মুনাফার হারকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। কর্পোরেট দুনিয়ার অসন্তোষকে দূর করার জন্য সরকার নয়া-উদারবাদী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখল, দেশের সম্পদ তাদের লুটের জন্য খুলে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হলো যথেচ্ছভাবে। কিন্তু রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকাকে নস্যাৎ করে দিয়ে দ্বীতিয় প্রজন্মের সংস্কারের জন্য কর্পোরেট দুনিয়ার আকাঙ্খার বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা বিনিয়োগে উৎসাহ বোধ করল না। রপ্তানী বাণিজ্য, শেয়ার-বাজার, মুদ্রা-বাজারের অবনমন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি বাণিজ্য নীতিকে অবাধ করে দিয়ে ও ইন্টারেস্ট রেট রিজিমের মাধ্যমে মানি-সাপ্লাইকে নিয়ন্ত্রণ করে রোখা যায় না, কিন্তু কংগ্রেস সরকার বিকল্প কোন পথ মাড়ালই না। অন্যদিকে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে দরিদ্র গ্রামীণ মানুষ ও অসংগঠিত শ্রমিকের মন জয়ের কংগ্রেসি প্রচেষ্টাও সফলতার মুখ দেখল না। কারণ কল্যাণকামী ব্যবস্থাগুলি কায়েম করতে যে সরকারি কোষাগার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করার জন্য বিকল্প কোন শিল্প-নীতির পথ তাঁরা অবলম্বন করল না এবং যেটুকু অর্থ সেক্ষেত্রে বরাদ্দ হলো তাও লুটেপুটে খেয়ে নিল দুর্নীতিবাজ কংগ্রেসি দলতন্ত্র ও তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনযন্ত্র।

কংগ্রেসি দোলাচল ও বামপন্থীদের ভূমিকা
             অনগ্রসর একটি দেশে মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা সাধারণতঃ দৈহিক শ্রমের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের সাথে ঐক্য স্থাপনের জন্য নিজে থেকেই মতাদর্শগতভাবে আগ্রহী হয়ে উঠে না। বামপন্থী মতাদর্শের যেটুকু প্রভাব পূর্বে ছিল তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তাই মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত পুরোনো পাবলিক সেক্টরের অবশিষ্টাংস, তথ্য-প্রযুক্তি ও ব্যক্তিগত খণ্ডের সাথে যুক্ত নতুন এই শ্রেণি এবং যারা মানসিক শ্রমের বাজারে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সেই শিক্ষিত শ্রেণির বৃহৎ অংশ (একাংশকে আম-আদমি পার্টি কিছু জায়গা করে দিতে পেরেছিল) সমস্যার চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী এক সমাধানের এক কল্পিত আলেয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। অথচ তারা সামাজিক কল্যাণের এক গঠনমূলক পথের দিকে আকৃষ্ট হতে পারত যদি অভ্যন্তরিণ বাজারকে সচল করা, দেশীয় উদ্যোগ ও পাবলিক সেক্টরকে সচল করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, ভূমি সংস্কার-কৃষির আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়নের পরিকল্পনা ও বৃহৎ পুঁজিপতিদের আয়ের উপর করের বোঝা চাপিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার নির্মাণ ইত্যাদি পদক্ষেপের দিকে সরকার হাঁটত। এক্ষেত্রে নয়া-উদারবাদী নীতিকে পুরোপুরি বিরোধিতা করতে হত। নয়া-উদারবাদ ও কল্যাণকামী এক রাষ্ট্রীয় নীতি – এই দুয়ের মাঝামাঝি এক পথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কংগ্রেসি সরকার না সন্তুষ্ট করতে পারল কর্পোরেট দুনিয়াকে, না দরিদ্র গ্রামীণ মানুষের মন জয় করতে পারল। আজকের বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকটকালে ও কেইন্সীয় অর্থনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার সময়ে এধরণের ভারসাম্য বজায় রাখার পন্থা সফলতার মুখ দেখতে পারে না। আর শিক্ষিত বেতনভোগী শ্রেণি ও শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি যখন অন্যপথে হাঁটে, তখন অসংগঠিত গরিব কায়িক শ্রমজীবী ও কৃষকদেরকেও তাদের সাথে টেনে নিয়ে যায়। সংসদীয় বামপন্থীরাও ভারতবর্ষের বিভিন্ন পেশার মানুষদের ও সামাজিক আন্দোলনগুলিকে একত্রিত করে ব্যাপক মঞ্চ তৈরি করার প্রয়াস নেননি, যেখানে তাদের আকাঙ্খা ও ক্ষোভের এক বাম-মতাদর্শগত সমাধানের পথের সন্ধান তারা করতে পারে। এক্ষেত্রে আম-আদমি পার্টির ভূমিকা বরঞ্চ প্রশংসনীয়। এই মতাদর্শগত শূন্যতার পরিস্থিতিতে বিত্ত পুঁজি, বণিক পুঁজি ও তাদের সহযোগী     শিল্প-মালিক ও কৃষি এলিটদের জোট উপরুল্লিখিত দুটি শ্রেণি ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এবং এরফলেই ভারতীয় রাজনীতিতে ঘটে এক চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী উত্থান। তাদের অর্থে ও এই শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকদের সহায়তায় গড়ে তোলা হয় প্রচারের এমন এক অভূতপূর্ব মায়াজাল যাকে ভেদ করে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি কারুর। এখানেই এই উত্থানের কাহিনীর শেষ নয়। এর পেছনে আরও কিছু বৈশষ্ট্য রয়েছে।

প্রতিবন্ধকতার মোহ ও দক্ষিণপন্থী সাংগঠনিক বিস্তার

             চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী উত্থানের প্রশ্নে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ও ব্যাক্তিরা একধরনের আত্মসন্তুষ্টিতে আক্রান্ত ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল যে ভারতীয় বৈচিত্র, মণ্ডল রাজনীতি, দলিত উত্থান এগুলির জন্য ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়াবে না। বাস্তবে এই প্রতিবন্ধকতাগুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে বহুদিন ধরে প্রতিহত করেও আসছিল। কিন্তু আর্থিক-সামাজিক চূড়ান্ত সংকটের সময় ও মানুষের আকাঙ্খা বৃদ্ধির ঊষালগ্নে বিকল্প কোন গণতান্ত্রিক পথের সন্ধান ছাড়া সমাধানের উগ্র-ভাবনার বিষম উন্নয়নের কল্পিত রূপের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা যায়। তাই ফিনান্স পুঁজি, বণিক পুঁজি ও কৃষি-এলিটরা বিহার উত্তরপ্রদেশের অতি-দলিত ও অতি-অবিসিদেরও তাদের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিহারে যদিও লালু যাদবের নেতৃত্বে যাদব-মুসলিম ঐক্য গড়ে উঠেছিল, উত্তর প্রদেশে মুজাফফর নগর দাঙ্গায় ইউপি সরকারের নেক্কারজনক ভূমিকার ফলে যাদব ভোটও এসপি’র ছত্রছায়া ত্যাগ করে বিজেপির কোলে আশ্রয় নেয়। উপরন্তু সাম্প্রদায়িক এক বিশাল সাংগঠনিক কাঠামো যে ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে গড়ে উঠেছে এব্যাপারটাকেও সবাই খাটো করে দেখেছেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কৃষি বিপর্যয়, উত্তর প্রদেশের মুজাফফর নগরের দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সংঘ পরিবারের মতাদর্শগত প্রচার সামাজিক ঐক্যের বিন্যাসে যে নতুন এক সমীকরণ গড়ে তুলেছে এদিকে কারুর দৃষ্টি পড়েছে বলে মনে হয় না। তবে যেসব রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি সক্রিয় রয়েছে সেইসব রাজ্যে সংঘ পরিবার খুব বেশি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আঞ্চলিক বুর্জোয়ারা কতদূর নয়া-উদারবাদের সাথে সমঝোতা বা বিরোধিতা করতে প্রস্তুত সে বিষয়টি যাচাই করে দেখা উচিত। আনন্দবাজারের মত গোষ্ঠীদের এই প্রক্রিয়ায় একটা ভারসাম্য রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বাম-গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও তামিল জাতিয়তাবাদী চেতনা ও দলিত আন্দোলনের ঐতিহ্য এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করেছে কিনা সেটাও বিচার্য। মমতার মুসলিম ভোট পাওয়ার বাধ্যবাধকতা ও জয়লিলতার এধরনের বাধ্যবাধকতা না থাকাই তাদের অবস্থানের একমাত্র কারণ কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয়।

জার্মানীর ইতিহাসের সাযুজ্য
            মোটামুটিভাবে প্রায় একই কালসীমায় ইতিহাসের কোন ঘটনার যখন পুনরাবৃত্তি ঘটে, তখন সাযুজ্য ও তূলনামূলক বিচারের পদ্ধতি সীমিত ক্ষেত্রে হলেও কিছু পথের সন্ধান দেয়। ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে জার্মানীর পুঁজিবাদের বিকাশ শুরু হয়েছিল কিছুটা বিলম্বে। পুঁজিবাদের বিকাশ এবং তার অপূর্ণতা ও দুর্বলতা, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দুর্বলতা, পুঁজির ও সামাজিক শ্রেণির এবং ওয়েমার সংসদীয় ব্যবস্থার সংকট ইত্যাদি হিটলারের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক উগ্র-জাতিয়তাবাদের দিকে জনগণকে আকৃষ্ট করতে ও ফ্যাসিস্ট উত্থানে গণ-সমর্থন লাভে নাজি পার্টিকে সফলতা প্রদান করেছিল। ওয়েমার গণতন্ত্রের জার্মানে ১৯৩০ অব্দি মোটামুটিভাবে ভারী-শিল্প মালিকদের ও সংগঠিত শ্রমিকদের এক কোয়ালিশন বজায় ছিল। এই কোয়ালিশন তৈরি হয়েছিল পুঁজিবাদী গঠন প্রক্রিয়ার অগ্রগতির সময়ে এস্টেট মালিক বা কৃষি এলিটদের সাথে পুঁজির দ্বন্দ্বকে প্রাধাণ্য দিয়ে। ক্ষমতার অংশীদারী হয়ে সংগঠিত শ্রমিকের দরকষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকের মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, চাকরির স্থায়ীত্ব ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ১৯১৪ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে যুদ্ধ ও বিপ্লবের প্রেক্ষিতেই পুঁজির সংকটের পর্যায় শুরু হয়। ফলে শ্রমের জন্য ব্যয় বৃদ্ধির ফলে শিল্প-পুঁজিপতিদের মুনাফা কমে যাওয়াকে তারা মেনে নিতে পারেনি এবং তারা এস্টেট-মালিক তথা কৃষি-এলিট ও ব্যাঙ্কারদের সাথে আঁতাত করে শ্রমের বিরোধিতায় নেমে পড়ে। এই আঁতাত গড়ে উঠে রপ্তানী শিল্পের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করে কৃষি এলিট ও ফিনান্স পুঁজির জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়ে। এই জোট উগ্র সাংস্কৃতিক জাতিয়তবাদী আবেদনের মাধ্যমে মধ্যশ্রেণি, পেটি-বুর্জোয়া, বেতনভোগী সবাইকে নিজেদের পক্ষে টেনে নেয়। ১৯৩৫ সালের পপুলার ফ্রন্টের ধারণার আগে পর্যন্ত বামপন্থীরা শ্রমিক শ্রেণির বাইরে কর্মচারী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, পেনশনার, প্রফেশনাল, গ্রাহক, নাগরিক, করদাতা, কৃষক ইত্যাদি সমাজের প্রতিটি অংশের উদ্দেশ্যে বাম-মতাদর্শের ছত্রছায়ায় সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে কোন ব্যাপক জোট গড়ে তোলার আবেদন জানায়নি ও প্রচেষ্টা নেয়নি। উৎপাদনী সম্পর্ক বা সামাজিক সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণের সময়ে বামপন্থীরা পেটি-বুর্জোয়া এবং শাসক শ্রেণির সাথে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি এই ফ্যাসীবাদীকরণে সহায়তা করেছে। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (এনএসডিএপি), যাদের মূল সমর্থন ভিত্তি ছিল পেটি-বুর্জোয়াদের মধ্যে, সমাজের সব অংশ এমনকি মজুরি-শ্রমিকদেরকেও তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে নেয় এবং তারা একাজটি করে সমাজবাদ-সাম্যবাদ বিরোধী এক উগ্র-জাতিয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জাগরণের আহ্বানে। তাদের এই উত্থান ঘটে ওয়েমার সংসদীয় গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে তাকে ভেঙে দেওয়ার মনোবাসনা নিয়ে। পরস্পর বিপরীত আকাঙ্খার বিভিন্ন শ্রেণির সমর্থন আদায় করেও হিটলার ও নাজি নেতৃত্ব এলিট শ্রেণিকে আস্বস্ত করতে সমর্থ হন যে ব্যবস্থার সংকটকালে তারাই এলিট স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে সক্ষম এবং নাজি পার্টির ক্ষমতায় আরোহণের ক্ষেত্রে এলিট-ফাণ্ডেড ব্যাপক মিডিয়া প্রচার তাদেরকে সহায়তা করেছিল। হিটলারি ফ্যাসিস্ট উত্থানের সাথে ১৯৩০-৩২ সালের ব্রুনিং ও পাপেনের কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পৃথক করে না দেখার মাশুল গুণতে হয়েছে জার্মান কম্যুনিষ্টদের। হিটলারের জমানায় ওয়েমার-জার্মানীর ফ্যাসিবাদীকরণের বাকী ইতিহাস সম্পর্কে সবাই অবগত। গোটা জার্মানী জাতি এখনও হিটলারি রাজত্বের কথা স্মরণ করে লজ্জায় অবনত।

রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণের সম্ভাবনা ও তার প্রতিকার
              ভারতবর্ষে যখন সাংস্কৃতিক উগ্র-জাতিয়তাবাদ কর্পোরেট দুনিয়ার খোলাখুলি মদতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন বিশ্ব ফিনান্স পুঁজি শিল্প-পুঁজির উপর প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলেছে। বর্তমান ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থা্র ডামাডোল, ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা ও পুঁজিবাদের সংকটে ত্রস্ত এলিট-শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনায় ত্রাতা হিসেবে তাদের উপরই বাজি রেখেছে। সুতরাং এই নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সংঘ পরিবারের উগ্র-জাতিয়তাবাদকে মোদী সরকার কী করে সামলায় এটা নিশ্চয়ই দেখার বিষয়। কারণ সংঘ পরিবারের অভ্যন্তরে স্তিমিত হয়ে যাওয়া জাতীয় অর্থনীতির প্রবক্তারা অনুকুল পরিস্থিতিতে মুখ খোলার চেষ্টা করতেও পারেন। সংসদকে কম গুরুত্ত্ব দিয়ে এক্সিকিউটিভ সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ চালাতে গেলে ভাজপার অভ্যন্তরে অনেককেই অসন্তুষ্ট করবে, সেই অসন্তুষ্টিকে কীভাবে প্রশমিত করা হয় সেটাও দেখার। “লেস গভার্ণমেন্ট, মোর গভার্ণন্যান্স” শ্লোগানের অন্তরালে দরিদ্র্য ও সংবেদনশীল জনসমষ্ঠীকে ভর্তুকি প্রদানের মত রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকা ক্রমান্বয়ে তুলে দেওয়ার এলিট-শ্রেণির ইচ্ছা রূপায়ণে রাজ্যসভার বাধা অতিক্রম করতে কীধরনের সংসদীয় রীতি-বিরুদ্ধ প্রথা ব্যবহার করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে এটাও লক্ষ্যণীয়। উপরন্তু ভারতীয় সভ্যতা, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অঞ্চলের আকাঙ্খাকে মোদীর নেতৃত্বে সংঘ-পরিবারের প্রকল্প কীভাবে মোকাবিলা করে সেটাও দেখার বিষয়। এই সবগুলি নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্রকে পদদলিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণের জন্য অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতা নয়, বিশেষ করে সেই পরিস্থিতিতে যখন নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনবোধ করে না। এই প্রয়োজনের বাস্তবতা তৈরি হতে পারে যদি প্রতিটি সংসদীয় দল নিজেদের আর্থ-সামাজিক নীতির পুনর্মূল্যায়ন করে এবং গণমুখী সাংগঠনিক পুনর্গঠন করে। কংগ্রেসকেও এই পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে, কারণ তাদের বর্তমান শক্তি থেকে উঠে আসার জন্য মোদীর দেখানো পথ খুব একটা সহায় করবে না, কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে নয়া-উদারবাদী পথের মোহ থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষণ এই অভূতপূর্ব হারের পরও দেখা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সংসদীয় ও অন্যান্য বাম দল, আম আদমি পার্টি, প্রকৃত বামপন্থীরা, কিছু পরিমাণে আঞ্চলিক ও জনগোষ্ঠীগত শক্তিগুলি। কিন্তু এই ভূমিকার আসল সূত্র লুকিয়ে আছে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন ও বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনগুলির শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্যে এবং তাই প্রাথমিক পর্যায়ে সমাজকর্মী ও বামপন্থীদের একাজে গুরুত্ত্ব সহকারে হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং তার উপর ভিত্তি করেই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পরিস্থিতির এধরনের ক্রমবিকাশ ঘটলে জার্মানীর মতন আমাদের রাষ্ট্রের ফ্যাসীবাদীকরণ দেখতে নাও হতে পারে কিংবা ফ্যাসীবাদ ক্ষণস্থায়ী ও সীমিত হতে পারে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে লজ্জাবনত হতে না হতে পারে। আমাদের একথা মনে রাখতে হবে যে উৎপাদন বা আর্থিক সম্পর্ক রাজনীতিকে নির্ধারণ করে, আবার রাজনীতি উৎপাদন সম্পর্ককে প্রভাবিত করে যার মধ্যে মতাদর্শগত প্রশ্নটি গুরুত্ত্বপূর্ণ। একে কোন একমাত্রিকভাবে নির্ধারিত বিষয় হিসেবে হিসেবে দেখা ঠিক নয়।

আসামের নির্বাচনী ফলাফলের বৈশিষ্ট্য

               অরুণোদয় পত্রিকা যেহেতু আসাম রাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়, তাই আসাম সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া উচিত। আসাম নির্বাচনের ফলাফলের ক্ষেত্রে নিম্ন আসাম ও বরাক উপত্যকার নির্বাচনী ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্ন আসাম বিশেষ করে কোকরাঝাড় নির্বাচন চক্রে নির্দল অ-বড়ো প্রার্থীর সাড়ে তিন লাখেরও অধিক ভোটে বিজয় এটাই প্রমাণ করে যে অকুতোভয়ে অ-বড়ো সব সম্প্রদায়ের মানুষ ভোট দিয়েছেন এবং তাতে বড়ো উগ্রজাতিয়তাবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের পিছু হটতে বাধ্য করবে এবং বড়োদের মধ্য থেকে ক্ষীণ হলেও গণতান্ত্রিক আওয়াজ উঠে আসার সুযোগ তৈরি হবে। এই পরিস্থিতিতে সব জনগোষ্ঠীর এক ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়ে উঠার পথ প্রশস্ত হবে। বরাক উপত্যকার দুটি নির্বাচন চক্রের ফলাফল এটাই দেখায় যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে, তখন বরাকের দুটি কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল গণতান্ত্রিক পর্যবেক্ষকদেরকে আশান্বিত করেছে। করিমগঞ্জের এইউডিএফ প্রার্থীর লক্ষাধিক ভোটে জয় এটাই দেখায় যে সেখানে মুসলিম ও নমঃশূদ্র ভোট এককাট্টা হয়েছে এবং বিজয়ী প্রার্থীর অন্যান্য সম্প্রাদায়েরও ভোট প্রাপ্তি ঘটেছে। শিলচর নির্বাচন চক্রে এইউডিএফ প্রার্থীর লক্ষাধিক ভোট প্রাপ্তি সত্ত্বেও পয়ত্রিশ হাজারেরও অধিক ভোটে কংগ্রেস প্রার্থীর জয় থেকে বোঝা যায় যে মুসলিম ও চা-শ্রমিক ভোট ছাড়াও বিজয়ী প্রার্থীর অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভোট প্রাপ্তি ঘটেছে। শিলচরে এইউডিএফ-এর প্রাক্তণ কংগ্রেসী মুসলিম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট এইউডিএফ-এর সমর্থকদের ভোট না কংগ্রেসী স্যাবোতাজজনিত ভোট এব্যাপারে পর্যবেক্ষকরা সন্দিহান। এব্যাপারে অনেকেরই মত এই যে এইউডিএফের প্রাপ্ত ভোট আসলে কংগ্রেসী ভোট, এইউডিএফের ভোট নয় এবং এইউডিএফের ভোট কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষে গেছে। উভয় নির্বাচনী চক্রে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বরাক উপত্যকার নির্বাচনে সে অর্থে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটেনি। নিম্ন আসাম ও বরাক উপত্যকার নির্বাচনী ফলাফল গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনরুত্থানের জন্য আশাব্যঞ্জক।  

নরেন্দ্র মোদীর প্রধান মন্ত্রী রূপে রাজ-অভিষেকের পর ‘নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য’ এই মূল নিবন্ধে সংযোজন ঃ
২৬ মে ঘটা করে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। এবারের এই অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ ছিল মালদ্বীপ সহ সার্ক দেশসমূহের উপস্থিতি। পাকিস্তানের উজিরে আজম নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি ও দুই রাষ্ট্র-প্রধানের মধ্যে নিভৃতে বার্তালাপ সবচাইতে বেশি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। এই সরকারের আসল এজেণ্ডা যে উন্নয়ন এবং সার্ক দেশসমূহের অভ্যন্তরিণ বানিজ্যের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করার জন্যই এই প্রয়াস তাতে আর অনেক বিশেষজ্ঞদেরই কোন সন্দেহ রইল না। বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধণ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে যে জটিল বিষয়গুলি রয়েছে তার মীমাংসার পথে যেন হাঁটে বর্তমান সরকার এটাই ছিল এলিট শ্রেণির আকাঙ্খা। কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশের সাথে এভাবে সম্পর্ক স্থাপন করার রণকৌশলে ভাজপার কোর-কনস্টিট্যুয়েন্সি তো সন্তুষ্ট হতে পারে না। তাই এই মহা-সমারোহের পর চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই প্রধাণমন্ত্রী দপ্তরের রাজ্য-মন্ত্রী উস্কে দিলেন ৩৭০ ধারা নিয়ে বিতর্ক এবং তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলো আরএসএস-এর সদর দপ্তর। প্রধানমন্ত্রী ফেডারেল কাঠামোকে শক্তিশালী করার কথা বলে জয়ললিতাদের বার্তা পাঠালেন বটে, কিন্তু সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে তাঁর রাজ্য মন্ত্রীর চটজলদি মন্তব্যের ব্যাপারে কিছু বললেন না। অন্যদিকে এই সরকারের শুরুয়াতটাও হয়েছে অর্ডিন্যান্সের মত একটি হাতিয়ার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে যা গণতান্ত্রিকদের আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। কালো টাকার সন্ধান ও উদ্ধার নব-গঠিত কমিশনের তদন্তের দায়রা থেকে কতটুকু বেরোতে পারবে তা এখনো সন্দেহের আবর্তে, কারণ এক্ষেত্রে আমেরিকানদের স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে এবং পূর্বতন সরকারও কালো টাকার সন্ধানে অনেক কুনাট্য করেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ভারসাম্যের খেলা কিছুদিন চলতে থাকবে, অন্ততঃ বিভিন্ন রাজ্যের আশু নির্বাচনগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তো বটেই। আমাদের সংস্কারমুখী অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণাই করে দিয়েছেন যে রপ্তানী বৃদ্ধি করে জটিল আর্থিক পরিস্থিতিকে সামলানো ও বিকাশের হার বৃদ্ধি করাই তাঁর প্রাথমিকতা। রপ্তানী নির্ভর বিকাশ যে বিশ্ব বিত্ত পুঁজি ও বণিক পুঁজির কাছে সবচাইতে বেশি কাম্য এখন আর তা খোলসা করে কাউকে বোঝাতে হয় না। বর্তমান বিশ্বে বিত্ত পুঁজির নিয়ন্ত্রক আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট। সুতরাং সার্ক দেশসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমেরিকান প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করে ও দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে স্বল্প সময়ের জন্য নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করার জন্য পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যে আমেরিকা তার আর্থিক অবস্থাকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপীয় দেশসমূহকে ক্ষতিপূরণের দায় জার্মানীর উপর চাপিয়ে দিয়ে যে ভার্সাই চুক্তি হলো, তাতে জার্মানী আমেরিকার কাছ থেকে ধার নিতে বাধ্য হলো এবং জার্মান পুঁজিবাদ রপ্তানীভিত্তিক উৎপাদনের উপর গুরুত্ত্ব আরপ করতে গিয়ে চাহিদা মেটাতে বাস্তবে প্রভূত আমদানী বৃদ্ধি ঘটালো এবং ধারের জন্য উত্তরোত্তর আমেরিকান ব্যাঙ্কারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ভিন্ন প্রেক্ষিতে অনুরূপ ব্যালেন্স অব ক্রাইসিসের মধ্যে ১৯৯০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে মনমোহন সিংহকে কাঠামোগত পুনর্গঠনের নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি চালু করতে হয়েছিল। আমেরিকান বিত্ত পুঁজির উপর নির্ভরশীল জার্মানী তথা ইউরোপীয় দেশসমূহ এই ঋণ-কাঠামোকে ধরে রাখার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারল না। তীব্র বেকারত্ব ও জনগণের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া যে চাহিদার সংকট তৈরি করল তাতে উৎপাদনী বিনিয়োগের ক্ষেত্রকে এবং আমেরিকার ধার দেওয়ার ক্ষমতাকেও সংকুচিত করে ফেলল। এই সংকটের চূড়ান্ত পড়িনতি ১৯২৯ সালের শেয়ার বাজার পতন ও মহামন্দার শুরুয়াত। বিত্ত-পুঁজি নির্ভর বিকাশের এই ইউরোপীয় প্রজেক্টের বাইরে রইল একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া যারা বিপ্লবোত্তর পরিকল্পনা-অর্থনীতির পথে হাঁটছিল। পুঁজিবাদের এই সংকট ও ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লবের পর গোটা ইউরোপে আন্দোলনমুখর শ্রমিক শ্রেণি এবং বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির বিকাশের বাস্তবতায় গড়ে উঠল পুঁজি-শ্রমের সমঝোতার নিউ-ডিল। ইউরোপের পুঁজিবাদের পুনরায় জেগে উঠা নির্ভর করছিল জার্মান অর্থনীতির সুস্থিরতা ও বিকাশের উপর। জার্মানীর বাস্তবতার অতি-মূল্যায়ন করে কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিল যে জার্মানীতে বিপ্লব হয়ে যাবে ও শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করে নেবে এবং তাদের এই অত্যুৎসাহের ফলেই কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজ-গণতন্ত্রীদের সাথেও ঐক্য স্থাপন করার কথা ভাবল না। এই সুযোগেই ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হলো ও হিটলারের বিশ্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। জার্মানীতেই এই প্রক্রিয়া গড়ে উঠার পেছনে সম্ভবত আরেকটি কারণ ছিল। ফরাসী বিপ্লব যেভাবে ফরাসীদের মনোজগতে লিবারেল-ডেমোক্রেসীর মূল্যবোধ গড়ে তুলেছিল, জার্মানীতে সেরকম কোন ঐতিহ্য ছিল না। যাইহউক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে স্বল্প সময়ের জন্য আমেরিকার অংশগ্রহণ অন্যান্য দেশের তূলনায় আমেরিকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত করে রাখল এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ধার প্রদানের জন্য আমেরিকা বিত্ত পুঁজির প্রধান কেন্দ্র হয়ে রইল। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ও সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য কোন একক শক্তি আর রইল না। কিন্তু মুনাফা ও সঞ্চয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুজিবাদের দীর্ঘম্যাদী সংকট আবারও তৈরি হয়েছে সত্তরের দশকে। সুতরাং আরেকটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করার পথে হাঁটছে বিশ্ব-পুঁজিবাদ। এই পর্যায়ে মতাদর্শগত স্তরে সোভিয়েত রাশিয়ার মত কোন কম্যুনিস্ট বিকল্পের ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে না। তবে ভোগ্যপণ্যের ও মিলিটারী উৎপাদনী মেশিনকে চালু রাখার জন্য আমেরিকান বিশ্ব-আধিপত্যের আর্থিক ও সামরিক কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদর্শন শুরু হয়ে গেছে। আর্থিক দিক দিয়ে চিন এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, ভাঙনের পরও রাশিয়ার সামরিক ক্ষমতা অটুট। চিন সমুদ্র উপকূলে শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাশিয়া ও চিন যৌথ মহড়ায় অবতীর্ণ হয়েছে, ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিয়েছে যে রাশিয়া তাদের রণকৌশলগত ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই ছেড়ে দেবে না। ২০০৮ সালের শেয়ার বাজার পতনের পর আমেরিকার আর্থিক ক্ষমতাও দুর্বল হয়েছে। মোদী সরকার ও অন্যান্য সার্ক দেশগুলি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির এই দ্বিবিধ শক্তির রণকৌশলগত খেলায় কী বিদেশ নীতি অবলম্বন করে এটাও দেখার বিষয়। তবে বিশ্ব-পুঁজিবাদের এই সংকটময়কালে সীমিত যুদ্ধ, ফ্যাসীবাদী উত্থান ও তার বিপরীতে মেহনতি মানুষের আন্দোলনমুখী উত্থান যে এক বাস্তব পরিস্থিতি হিসেবে দেখা দিয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। শক্তির ভারসাম্য যুদ্ধ-ফ্যাসীবাদ-ধ্বংস না গণতন্ত্র-সাম্যবাদ-সৃষ্টির পক্ষে বিকশিত হবে তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ও রণনীতিগত পন্থা অবলম্বন করতে হবে এবং একাজটি করতে হবে মানবতা ও মানব সভ্যতার স্বার্থেই। ইতিমধ্যেই পরিবেশ বিপর্যয় ও যুদ্ধ সামগ্রীর সম্ভার মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ঐক্য, সৌভাতৃত্ব ও সাম্যের শ্লোগান আবারও বিশ্ব-মানবের আঙ্গিনায় মুখরিত হোক – এটাই কাম্য।         
   

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

(ইউনিকোডে যারা পড়তে পারবেন না, তাদের জন্যে ছবিতে রইল নিচে)               








বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,


৯শে মে শহিদ দিবসকে সামনে রেখে ১১মে মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির কার্যালয় হলে কোরাসের উদ্যোগে এক মনোজ্ঞ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো। এই আলোচনা সভায় বক্তারা প্রশ্ন তোলেন ১৯৬১-৭১-৮৬-এর ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৯১-তে এসে আমাদের কেন উগ্র-হিন্দু সাম্প্রদায়িকতায় আশ্রয় নিতে হল? ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কী করে প্রতিক্রিয়াশীলতায় রূপান্তরিত হলো? ১৯ শে মে’র পর ১৯ শে জুনের ঘটনা কেন ঘটল? কেন একাত্তরের ভাষা আন্দোলন পর্যবসিত হলো গুণ্ডাবাহিনীর সম্মুখ সমরে? প্রশ্ন উঠল একষট্টির ভাষা আন্দোলনের পর যে চুক্তি হলো তার ৬(ক) ধারা অনুসারে তৎকালীন কাছাড় বা বর্তমান বরাক উপত্যকার প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাথে সরকারি-প্রশাসনিক যোগাযোগের মাধ্যম সেইসব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় হওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য উনিশ উদযাপনের আয়োজন থেকে কেন কোন জোরদার দাবি উত্থাপিত হলো না? কেন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বাঙালিরা নীরব ভূমিকা পালন করছে? কেন চা-বাগানে বসবাসকারী চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ করে দিতে উনিশের ঐতিহ্য বহনকারীদের কোন তৎপরতাই লক্ষ্য করা গেল না?

      
   নির্দিষ্ট আলোচকরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করেন। ড০ সুবীর কর ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকে স্থানীয় ও উদ্বাস্তুদের দ্বন্দ্বকে সমাধান করার উপযুক্ত প্রয়াস ও পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেন এবং এই সুযোগে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বাম আন্দোলনকে প্রতিহত করার মানসিকতা থেকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হিসেবে তিনি ঘটনা পরম্পরা বিশদভাবে উল্লেখ করেন। সঞ্জীব দেবলস্কর বলেন ভাষা নিয়ে বাঙালিদের আবেগ-প্রবণতা আর কোন জাতির মধ্যে দেখা যায় না। আক্রান্তরা আক্রমণকারী হতে পারে না এই সূত্র ধরে তিনি বাঙালি-অবাঙালি সম্পর্কে বাঙালির উদারতার নিদর্শন তুলে ধরেন ও মধ্যযুগের অন্ধকারময় সময় পেরিয়ে বাংলা ভাষা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এক বিকাশমান ভাষা বলে উল্লেখ করেন। মুজাম্মিল আলি লস্কর সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন যে বাঙালি শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সমাজ তাদের প্রতিবেশিকে আলিঙ্গন করে নিতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। প্রতিবেশিদের সাথে নিয়ে যদি একজোট না হওয়া যায় তাহলে আমরা বাইরের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারব না। শিক্ষাহীনতাই বঞ্চিত মুসলিম সমাজের আসল সমস্যা যারা অতি সাধারণ প্রলোভনেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু আজ নিজস্ব সামাজিক প্রচেষ্টায় এক শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠছে এবং আমরা একে অপরকে চেনার ও আপন করে নেওয়ার প্রচেষ্টা নিলে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে এবং এক্ষেত্রে শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের দায়িত্ব অনেক বেশি এবং এই প্রক্রিয়ায় ঐক্যের শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হবে। ১৯ শে মে থেকে কেন ১৯ শে জুন হলো তার সঠিক অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা এখনও করা হয়ে উঠেনি, দোষারোপ করেই আমরা আমাদের দায় সারছি। ড০ মৃন্ময় দেব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বর্তমান প্রেক্ষিতকে বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে বরাকের স্থানিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে এসে বলেন যে বাঙালি সত্ত্বাও বহুকেন্দ্রিক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বরাকের কেন্দ্রটির জিয়নকাঠি হয়ে উঠেছে অসমীয়া উগ্রজাতিয়তাবাদী কোন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাকে তিনি কনডিশনড রিফ্লেক্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য সময় এই কেন্দ্রটি আধিপত্যবাদী ও কলকাতামুখীন। ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সবচেয়ে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন বাংলা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার শ্রেণি থেকে যারা এখানে এসছেন তারাই জনমত গঠনে প্রাধাণ্যকারী অবস্থানে রয়েছেন এবং তাদের বর্ণহিন্দু জমিদারি মানসিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ধারিত মানসিকতা এই বিভাজন দূর করার প্রধান প্রতিবন্ধক। শেকড় থেকে উচ্ছেদ হয়ে এর স্মৃতি বহন করে চলেছেন এই উদ্বাস্তুরা কিন্তু এখানে নতুন কোন শেকড় গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে বরাকের বিভিন্ন সমাজ থেকে উঠে আসা বুদ্ধিজীবীরাও ভাষা আন্দোলনের হাল ধরতে পারেননি এখনও। এভাবে তিনি এক কাঠামোগত ও কার্যপ্রণালীর দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেন। কাজল দেমতা ঝাড়খণ্ডী তথা চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের করুণ অবস্থা বর্ণণা করেন এবং তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাবকে দায়ি করেন। মাতৃভাষায় তাদের পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকস্তরেই বাধার সম্মুখীন হয় এবং পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উনিশের মে উদযাপনের ক্ষেত্রে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মর্মবেদনা ব্যাক্ত করে তিনি বলেন একটি অনুষ্ঠানে ঝুমুর নাচ ও আদিবাসী গান পরিবেশন করতে দিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী উদ্যোক্তাদের আপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। উনিশের মে’র দিন বাংলা ছাড়া আর কিছু চলবে না বলে তারা আপত্তি তোলেন। ড০ শান্তি কুমার সিং বলেন যে তাঁরা ভীষণভাবে মর্মাহত এই কারণে যে যখন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক পদটি প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট ভাষা না জানা অসমীয়াভাষীদের দিয়ে তা পূরণ করে দেওয়া হচ্ছে তখন কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিদের তরফে কোন আপত্তি উঠেনি। সর্বশেষ বক্তা সুব্রত কুমার পাল (শ্যামা) একষট্টির আন্দোলনের সফলতা ও বিফলতার দিক তুলে ধরে বলেন যে আমাদের সীমিত সফলতা ভাষা চুক্তির ৬(ক) ধারার সংযোজন। কিন্তু এরপর অধিকারের আন্দোলনকে আর প্রসারিত করতে পারিনি এবং তার অন্তর্নিহিত কারণ একষট্টির আন্দোলনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। করিমগঞ্জ জেলার বিস্তৃত বাস্তব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি দেখান কোথায় এবং কীভাবে একষট্টির ভাষা আন্দোলন শহর-গঞ্জের এলিট সীমানা অতিক্রম করে নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমান হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যার্থ হয়েছে এবং তারা এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। আন্দোলনের উদ্যোক্তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার-মিরাসদার শ্রেণি থেকে উঠে এসেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই রায়ত শ্রেণির আম-জনতারা ন্যায্য দাবিকেও সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের পরও একান্নবইতে এসে করিমগঞ্জ জেলার অবিসিরা হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আশ্রয় নিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কোন স্যাকুলার রাজনীতি গড়ে তোলার বিফলতা ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকেই দেখায়। এখনও যখন বিটিএডিএ-তে শিশুদেরকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তখনও আমরা বাঙালি-মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধান্বিত। এই প্রক্রিয়া আমাদের সবার অস্তিত্বকে ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। সবশেষে বিটিএডির ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর আইনি ও সহিংস আক্রমণের বিরুদ্ধ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের এবং সব জনগোষ্ঠী যাতে তাদের নিজস্ব সমস্যা তুলে ধারতে পারে ও তার সমাধানে যৌথ প্রয়াস নিতে পারে তারজন্য সব জনগোষ্ঠীর এক যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন সভার সঞ্চালক বিশ্বজিত দাশ।         
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য
[ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে এই বিষয়ের উপর কোরাস আয়োজিত আলোচনা সভায়
কোরাসের অ্যাপ্রোচ পেপার
স্থান ঃ মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির কার্যালয়, পার্করোড।
তারিখ ঃ ১১-০৫-২০১৪।   সময় ঃ সকাল ১০-৩০ টা]

প্রতিবারের ন্যায় ১৯শে মে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে এবারও পালিত হবে। আমরা সবাই, যারা এদিবসকে ঘটা করে পালন করতে প্রতিবছর সচেষ্ট থাকি, অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে সেই দিবস পালন নেহাতই এক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে এবং ভাষিক অধিকারের প্রশ্নে যে প্রাণশক্তি সমগ্র জাতিকে নাড়িয়ে দেয় তা ক্রমশঃই ক্ষীয়মাণ ও সংকীর্ণ বদ্ধজলায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আমাদের মনে হয় একষট্টির আন্দোলনের যে ঐতিহ্য আমাদেরকে নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার কথা ছিল তা করতে না পারার পেছনে ঐতিহ্যকে পুননির্মাণ করার আমাদের উদ্যোগের অভাব দায়ি। এই ভাবনা থেকেই কোরাস এবার নির্দিষ্ট দিবসের পূর্বে ১১ মে, ২০১৪ তারিখে এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছে যাতে ভাষা দিবস পালনে আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে শেখার সূত্রপাত ঘটায়। এই আলোচনা সভায় আলোচকদের উদ্দেশ্যে প্রথামাফিক উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এবং কোরাস আশাবাদী এগুলির উপর ভিত্তি করে এই আলোচনাসভা নতুন দিক উন্মোচিত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে সক্ষম হবে।

           (১) একষট্টির আন্দোলন যদিও সীমাবদ্ধ ছিল রাজ্য ভাষা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দ্বারা এক ভাষাকে অন্য ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের মধ্যে, কিন্তু তার অন্তর্বস্তুতে ছিল মাতৃভাষায় প্রশাসনিক কাজকর্ম ও পঠন পাঠনের অধিকারকে সাব্যস্ত করার নিরন্তর ও দীর্ঘকালীন গণতান্ত্রিকীকরণের এক প্রক্রিয়ার শুরুয়াত। আমরা জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরের এই মর্মবস্তুকে আড়াল করে শুধুমাত্র একমাত্রিকভাবে বাইরের চাপের বিষয়কেই গুরুত্ত্ব দিয়েছি। চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি নিশ্চিতভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ, কিন্তু অভ্যন্তরিণ গণতন্ত্রকে বিকশিত না করলে যে বাইরের চাপের কাছে প্রতিনিয়ত নতি স্বীকার করতে হয় – এই সাধারণ সত্য থেকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। ফলে একষট্টির আন্দোলনের বিষয়ও সফলতার মুখ দেখতে ব্যার্থ হয়েছে এবং নিরন্তর হয়ে চলেছে। এই বিফলতার স্বরূপটা কী?

        (২) বাঙালি ও বাংলা ভাষার কথাই ধরা যাক। ভাষা যদি জনগোষ্ঠীয় ঐক্যের এক প্রধান মাধ্যম হয়, তাহলে এই ভাষার অন্তর্গত প্রতিটি সমাজ উক্ত ভাষার সাথে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি সমাজের মায়ের মুখের বুলি এক সাধারণ মায়ের ভাষায় রূপান্তরিত হতে হবে যাতে এই ভাষা সবার মাতৃভাষা হয়ে উঠে। কিন্তু মান্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গঠন প্রক্রিয়ায় ফোর্ট-উইলিয়ামের মত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মুখ্য ভূমিকা থাকায় এলিট শ্রেণির সংস্কৃত প্রভাতযুক্ত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। শ্রীচৈতন্য নিজে সিলেটি হয়েও সিলেটি বুলিকে অপবাদ অবহেলা করে যে ভাব-আন্দোলন করেন তাতে নদীয়ার আঞ্চলিক বুলি মান্য ভাষায় স্থান পায়। কিন্তু ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল আধিপত্যবাদী স্বার্থের প্রভাব ও বৈষ্ণব ভাব-আন্দোলন বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে বাংলা ভাষার অনেক গণতান্ত্রিক পরিমার্জন পরিবর্ধন হয়েছে, কিন্তু এখনো বাঙালির ভাষা হিসেবে দাবি করা এই ভাষা সমগ্র বাঙালির মান্য ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। এই উপলন্ধি কিংবা তার বিকল্প উপলব্ধি থেকে মান্য ভাষার বিষয়কে কীভাবে বিচার করা যায়?

          (৩) কৈবর্তদের মত সম্প্রদায় কিংবা মুসলমানি বুলি যখন মান্য বাংলার সাথে কোন যোগসূত্রই খুঁজে পায় না, তখন এটা ধরে নেওয়া যায় যে এই ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডিকে অতিক্রম করতে পারেনি এবং আমাদের ভাষা জাতিয়তাবাদ অত্যন্ত দুর্বল ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি ভাষিক জাতিয়াবাদের দুর্বলতার স্বরূপ কী এবং  এনিয়ে আমাদের কী করণীয়?

         (৪) ভাষার সাথে গণ-শিক্ষার প্রশ্ন ও শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যখন বাংলা মান্য ভাষাটি সমগ্র বাঙালি সমাজের সাধারণ মাতৃভাষা হয়ে উঠতে পারেনি, তখন নিশ্চিতভাবে আমাদের এই ভাষার বিকাশের স্বার্থে এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেহেতু ভাষার নির্মাণ সমাজের এক অভ্যন্তরিণ নিরন্তর জীবন্ত নির্মাণ, তাই গরিষ্ঠাংশ শিক্ষাবিহীন কোন সমাজের ভাষা ও ভাষিক ঐক্যও দূর্বল ও ভঙুর হতে বাধ্য। আবার যেহেতু মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ উৎকৃষ্ট ও কার্যকরী পদ্ধতি, তাই মুখের বুলিকে গুরুত্ত্ব দিয়েই আমাদেরকে পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় আমরা     ধর্ম – বর্ণ বিভাজনের উর্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উর্ধে ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যকে প্রসারিত করতে পারি এবং সবধরণের ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবিলা করার ভিত্তিভূমি তৈরি করতে পারি। বিশ্বায়নের প্রকোপকে মোকাবিলা ও ভাষিক জাতিয়তাবাদী ঐক্য কীভাবে করা যেতে পারে? বরাক উপত্যকার সমাজে শিক্ষা আন্দোলনের স্বরূপ কী হতে পারে?

         (৫) ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল প্রভাব থেকে ভাষাকে মুক্ত করেই ভাষার উপর যে বর্তমান বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন তার মোকাবিলার এক গণতান্ত্রিক পথ নির্মাণ করা সম্ভব। আমাদের একথা স্মরণে রাখা এবং একে উন্মোচিত করা জরুরি যে ব্রিটিশ কলোনিয়্যালিজম থেকে আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে এক ধারাবাহিকতা ও ছেদ দুটোই রয়েছে। ভাষাকে ও ভাষিক অধিকারকে বাঁচাতে গেলে আমাদেরকে ধারাবাহিকতার এই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা এবং মাঝেমধ্যে ভঙুর বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টার অন্তর্নিহিত সূত্রগুলি আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দীর্ঘ ইতিহাসে ভাষা কীভাবে বিপন্ন হয়ে উঠছে?

            এতো গেল বাংলা ভাষা ও বাঙালির গণতান্ত্রিকীকরণের বিষয়। এবার দেখা যাক আমাদের প্রতিবেশি অন্যান্য ভাষিকগোষ্ঠীদের ঐক্যের প্রশ্নটি –

            (১) যে মাতৃভাষার আন্দোলনে একষট্টির বাঙালিরা যোগ দিল, সেই বাঙালির উত্তরসূরীরা বিভিন্ন ভাষিকগোষ্ঠীর ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যান্ত্রিক ঐক্যের কথা বলল বটে, কিন্তু কখনওই এক গঠনমূলক ও জীবন্ত ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুব বেশি সফল হল না। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর ঐক্যের জন্য আমাদের কী করণীয়? অসমীয়া – বাঙালি ঐক্যও কোন পদ্ধতিতে গড়ে উঠতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়?

 
     (২) বাঙালিদের প্রতিবেশি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে বিশেষ কোন আগ্রহই দেখাল না। চা-বাগানে বসবাসকারী এই বিশাল জনগোষ্ঠীটি মাতৃভাষার অধিকারহীনতায় শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। গণশিক্ষা ছাড়া যে কোন অঞ্চলেই গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি হতে পারে না এই বাস্তব সত্যের প্রতি আমাদের অনীহা বরাক উপত্যকার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনল। উনিশের ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আনতে সক্ষম হলাম, ভাষা শহিদ স্টেশনও হয়ত একদিন হবে, আমরা আরও বহুবিধ দাবি উত্থাপন করলাম, কিন্তু ভিন জনগোষ্ঠীর দাবি ও অভিমানের প্রতি আমরা উদাসীন থাকলাম।   চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু মাতৃভাষার অধিকারের দাবি জানানোই যথেষ্ট নয়, উনিশের ঐতিহ্য আমাদেরকে যে আরও বিশাল কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানায় সেটা আমরা বিস্মৃত হলাম। বরাক উপত্যাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে অন্যান্যদের প্রতি আমাদের দায় অনেক – উনিশের ঐতিহ্য থেকে আমাদের সে দায়েরও উন্মোচন হোক আজকের আলোচনা থেকে। চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের ভাষিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কীধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত?      

আধিপত্যবাদ ও উনিশের ঐতিহ্য

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,



১৮ মে, ২০১৪ যুগশঙ্খ
।। অরূপ বৈশ্য ।।



অসমীয়া মধ্যশ্রেণির বোধোদয় ও বাঙালি উদারতা

ম্প্রতি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অসমীয়া মধ্যশ্রেণির ইতিহাস নিয়ে মূল্যবান গ্রন্থের লেখক ড০ প্রফুল্ল মহন্তের একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে অসমীয়া এক দৈনিক কাগজে। এই নিবন্ধে লেখক অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া থেকে জনজাতীয়দের দূরে ঠেলে দিয়ে অসমীয়া জাতির ধ্বংস ডেকে আনার জন্য অসম সাহিত্য সভা, কংগ্রেস সরকার ও অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজকে দায়ি করেছেন। গণতন্ত্রের প্রতি এই সজাগতা তার স্বাভাবিক নিয়মে আরও নতুন গঠনমূলক দিক উন্মোচিত করে। এই লেখাটি আসলে অসম সাহিত্য সভার কোন এক অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপ। অসম সাহিত্য সভার মত এক জনপ্রিয় অসমীয়া জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রতিষ্ঠানে এধরনের খোলাখুলি বক্তব্য পেশ এটাই দেখায় যে আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদের দীর্ঘ ইতিহাস অসমীয়া জাতিরও যে সমূহ ক্ষতি সাধন করেছে এই উপলব্ধি অসমীয়া মধ্যশ্রেণির মননে জায়গা করে নিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করেই যে উগ্রজাতিয়তাবাদ তার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে এই উপলব্ধি গড়ে ওঠা জরুরি এবং তার থেকেও জরুরি একে প্রতিহত করার কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা। তবে এই মধ্য শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগেই আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসের লুক্কায়িত তথ্যগুলি একে একে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। অন্য জাতির কল্যাণ সুনিশ্চিত না করে কোন জাতি নিজের কল্যাণ সুনিশ্চিত করতে পারে না – এটাই মানব সভ্যতার অমোঘ নিয়ম। কিন্তু ইতিহাসের করুণ পরিহাস এই যে আসামকে বধ্যভূমি করে তুলে, আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসে বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের লাগাতার গণহত্যার মুখে ঠেলে দিয়ে মানব সভ্যতার এই শিক্ষা নিতে হচ্ছে। এই শিক্ষা কতটা গভীর তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু নিবন্ধের লেখক যদি আরও একটু পেছন দিকে তাকাতেন তাহলে কী তিনি বাঙালির উদারতা - মহৎ আবেগপ্রবণতাকে আবিষ্কার করতেন, না তিনিও আঁতকে উঠতেন কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির ভূমিকার কলঙ্কিত অধ্যায়কে দেখে। এই আঁতকে উঠার কাহিনী নিশ্চিতভাবে একমাত্রিক নয়, এই শ্রেণির অভ্যন্তরেই তার প্রতিকল্প নির্মাণের প্রয়াস নিরন্তর অব্যাহত ছিল। কিন্তু যা প্রাধাণ্যকারী ভূমিকায় ছিল তা আঁতকে ওঠার মতই বৈকি।

ব্রিটিশ প্রভাবান্বিত বাংলার ভাষিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ

ইতিহাস ব্যাখ্যার পদ্ধতির প্রভূত উন্নতির পরও অতীত ও চলমান ঘটনাকে কিছু লক্ষণ ও তথ্য দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা সাধারণকে আচ্ছন্ন করে রাখে – বিশেষ করে বরাক উপত্যকার মত অঞ্চলে যেখানে ইতিহাস চর্চা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু পরিচিতি ও সংস্কৃতির বলয়কে চেনার জন্য শুধুমাত্র চর্চার অভ্যন্তরিণ কাঠামোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চলে না, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে এই চর্চা নির্মিত হয়েছে তার দিকেও তাকাতে হয়। ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল শাসকদের বাংলায় পদার্পণ ও কলকাতায় প্রথম রাজধানী গড়ে ওঠা বাংলার ভাষা-সংস্কৃতিকে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। উপনিবেশিক শাসনের ছত্রছায়ায় ও মদতে অতীত সাবলিল বাঙালি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় ছেদ ঘটিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির যে নতুন বয়ান তৈরি হয় তাকে খণ্ডন করার প্রভূত প্রয়াস সত্ত্বেও বাঙালির হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির মননকে এখনও এই বয়ান আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই এখনও যখন মধ্যযুগকে অন্ধকারময় ও যে সময়ে অসমীয়া জাতিয় চেতনা গড়ে ওঠেনি সেসময়কার অসমীয়াদের প্রতি কলকাতার বাঙালি ব্যক্তিত্ত্বের ভূমিকা ও অবদানকে বাঙালির উদারতার লক্ষণ হিসেবে যখন বরাকের কোন বুদ্ধিজীবী উল্লেখ করেন, তখন মর্মাহত হতে হয় বৈকি। কারণ এভাবে দেখার মধ্যে ব্রিটিশ প্রভাবে কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিদাম্ভিকতার সংমিশ্রণে নির্মিত রেঁনেসার বয়ানেরই পুনরুল্লেখ হিসেবে প্রতিভাত হয়। যদুনাথ সরকারের মত ইতিহাসবিদ এই প্রভাবেই জটিল ইতিহাসকে অতি-সরলিকরণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। ১৭৭০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষকে এঁরা ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠনের রাজত্বকে কখনও দায়ি করেননি। ব্রিটিশ রাজত্বকে কল্যাণকামী হিসেবে দেখার মধ্য দিয়েই জাতিয়তাবাদী রাজনীতির সাথে এক বড়সড় বিচ্ছেদ রেখা টানা হয়। এখান থেকেই নির্মিত হতে থাকে ভদ্দরলোকি আদবকায়দা, হিন্দু সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতা, মুসলমানদের অপর ভাবা, ভাষাকে মুসলিম প্রভাব মুক্ত করা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে নতুন ভাষিক-সাংস্কৃতিক বয়ান। এর পেছনে ছিল এই শ্রেণির জমিদার-মহাজনী স্বার্থের ভাবাবেগ এবং এজন্য এরা কৃষকদের উপর হওয়া কোন অত্যাচারকেই দেখতে অপারগ ছিলেন। তবে এর বিরুদ্ধ বয়ানও এই শ্রেণিভুক্ত কিছু বুদ্ধিজীবীরা নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু এরা কখনওই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে অষ্ট্রীয়া থেকে এক লেখায় সুভাষ বোস ভারতীয় ইতিহাসে ‘মুসলিম যুগের’ উল্লেখের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধকে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলা বিভাজনের ক্ষেত্রে এই বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির ভূমিকাই যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জয়া চাটার্যি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড গ্রন্থে। তাদের আধিপত্য কায়েম করতে তারা বাংলা বিভাজনকে কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন, এর বিনিময়ে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরণেও তাদের আপত্তি ছিল না। সি আর দাশের প্রজা-কৃষক পার্টিকে তারা হেয়র চোখে দেখতেন এবং পরবর্তীতে বাংলা বিভাজন রোখার জন্য শরৎ বোস ও আবুল হাসিমের প্রস্তাবকেও তারা আমল দেয়নি।  ব্রিটিশ শাসনের আশ্রয়ে এই শ্রেণিটি যে কীভাবে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে এবং নিম্নবর্ণীয়দের অধিকারের প্রতি উদাসীন থেকেছে তার ব্যাখ্যা পাই আমরা ইতিহাসবিদ শেখর বন্দোপাধ্যায়ের কাস্ট, পলিটিকস অ্যাণ্ড দ্য রাজ গ্রন্থে। মুগল আমলে প্রতিপত্তিশালী কৈবর্ত জমিদার ও স্বচ্ছল কৈবর্ত সমাজের সন্ধান পাওয়া যায় মেদিনীপুর অঞ্চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন মধ্যশ্রেণির সৃষ্টি করে তাতে নিম্নবর্ণীয়রা চিরতরে অধিকারহীন ব্রাত্যতে পর্যবসিত হন। ব্রিটিশদের প্রতি এই নব্য-মধ্যশ্রেণির আনুগত্য ও মুসলিম ও নিম্নবর্ণীয় কৃষক প্রজাদের প্রতি তাদের অবজ্ঞার কারণটি এভাবেই বোঝা যায়। সুতরাং অসমীয়া জাতিয় চেতনা যখন বিকশিতই হয়নি তখন কিছু সংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অসমীয়াদের প্রতি উদারতার সাথে ব্রিটিশ আনুগত্যে নির্মিত মতাদর্শের কোন বিরোধ ছিল না। তাই এই উদারতার নিদর্শনে আমাদের পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বাংলার কায়স্থ সমাজটি যে হিন্দি বলয়ের মত গঠিত হয়নি, তা গঠিত হয়েছিল করণিক শ্রেণি থেকে, যাদেরকে মনু উল্লেখ করেছিলেন ব্রাত্য-কায়স্থ হিসেবে, তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিত্রলেখা গুপ্ত তাঁর দ্য কায়স্থ – এ স্টাডি ইন দ্য ফর্মেশন অ্যাণ্ড আরলি হিস্টরি অব এ কাস্ট গ্রন্থে দেখিয়েছেন। এটা সম্ভবত একটা কারণ যে উপরিকাঠামোয় বাঙালি বর্ণহিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে একটা নমনীয়তাও ছিল এবং এদের মধ্য থেকেই বিরোধিতাও উঠে এসেছিল, কিন্তু সেই বয়ান কখনওই প্রাধান্যকারী অবস্থান নিতে পারেনি। ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগকে বিশিষ্টতা দেওয়ার প্রবণতার মধ্যেও খামতি রয়েছে। দেশ-রাষ্ট্রের সীমানাবিহীন ভাষিকগোষ্ঠী ভাষাকেই আবেগের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, দেশ-রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট হয়ে গেলে ভাষা ও দেশের আবেগ এক জায়গায় মিলে যায়। ভাষিক আবেগ যে গোষ্ঠী আবেগ ও স্বার্থের সীমানা অতিক্রম করেনি বাংলা বিভাজনের ইতিহাসই তার প্রমাণ। এবার বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের সমস্যা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।

নতুন পরিস্থিতিতে উনিশের ঐতিহ্যের পুনর্নিমাণ

বরাক উপত্যকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা যে সাম্প্রদায়িকতা একথা যে কোন পর্যবেক্ষকই স্বীকার করবেন। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা বঞ্চিত এবং তাদের ভাষাও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মত আক্রান্ত। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরাই আক্রান্ত। এই আক্রান্তরা পরিচিতির দিক দিয়ে মূলতঃ বাঙালি-মুসলমান হওয়ায় এখানকার ভাষা-সচেতন বাঙালি হিন্দু সমাজ কি আক্রমণকারীদের মিথ্যা ভাষণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না? নিম্ন অসমের অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে বাংলাদেশি তকমা সেঁটে দিয়ে প্রকারান্তরে হত্যালীলাকেও কি বৈধতা দেওয়া হয় না? এভাবেই তৈরি হয় আক্রান্তদের মধ্যেই আক্রমণকারীর মানসিকতা যে মানসিকতার বশবর্তী হয়েই ভাষা আন্দোলনে শহিদত্ব বরণ করা এই বড়ো জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীরা আজ হত্যার রাজনীতি করছে। শাসক শ্রেণির বঞ্চনা ও মতাদর্শের কাঠামোটি এতই সর্বগ্রাসী ও সুক্ষ্ম যে তা এক বঞ্চিতদের অপরের বিরুদ্ধ লেলিয়ে দিতে পারে। এখানে রাষ্ট্র কাকে মদত দিচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই আক্রান্তরা আক্রমণকারী হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে রাষ্ট্রের এই মদত গ্রহণ করতে প্রস্তুত করে রাখে। মতাদর্শের এই প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে না পারার ক্ষেত্র তৈরি হয় চিন্তা ও কাজের দৈন্যতা থেকে। চিন্তা ও কাজ পরস্পর সম্পৃক্ত। কিছু পূর্বধারণা, কিছু প্রতীক, কিছু প্রচলিত বয়ানকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে মস্তিষ্কের রসায়নকে নিয়ন্ত্রণ করলে কিছু স্টিরিওটাইপ তৈরি হয়। যে প্রতিবেশিকে বাস্তবে দেখা হলো না, আবার যদি বা দেখা হলো তাকে জানার চেষ্টা করা হলো না, কিন্তু তার সম্বন্ধে একটা মত তৈরি করে নেওয়া হলো। এভাবে যে মতটি নিজের বলে ভাবা হলো তা আসলে প্রচলিত আধিপত্যকারী মত। এভাবেই শাসক শ্রেণি তার বয়ানকে চাপিয়ে দেয় এবং মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করার সুপ্ত স্পৃহার বাস্তবায়নের সহজ পথ খুঁজে নেওয়া হয় শাসক শ্রেণির সাম্প্রদায়িক হাতিয়ারের মধ্যে যেখানে কিছু সংখ্যককে অপর বানিয়ে একটি ধর্মীয় বয়ানে অন্যদের উপর আধিপত্য স্থাপন করা যায়। বরাকের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তার উপর এই সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের আধিপত্য বিস্তারের আরেকটি সুবিধে রয়েছে। যেহেতু বরাক উপত্যকার বিশেষ করে শিলচরের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিটি মূলতঃ তৈরি হয়েছে তাদের দিয়ে যারা ছিন্নমূল হয়ে এখানে এসেছিলেন। সুতরাং ছিন্নমূল হওয়ার মর্মবেদনা এবং অতীত সচ্ছলতা হারানোর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে চোখে দেখা, বাস্তব অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনা আংশিক ঘটনাকে তারা সাধারণীকরণ করে ফেলেন এবং তাদের অপরকে খুঁজে পান। সাম্প্রদায়িকতার এই সুবিধা দূর করতে পারে নির্মোহ ইতিহাস চর্চা। বরাক উপত্যকার শিক্ষিত সমাজ হিসেবে আমরা এব্যাপারে বড্ডই স্থাণু। একষট্টির ভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ও বরাকের সমাজে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির শেকড় প্রোথিত করার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডী অতিক্রম করে আম  কৃষক-জনতার মধ্যে কোন যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হলো না। ফলে একদিকে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন যেখানে নিম্ন শ্রেণির হিন্দু-মুসলমানরা সমাবেশিত হয়েছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাবেশিত হয়েছিলেন উভয়ই পরাস্ত হলো। পরাজয়ের এক দীর্ঘম্যাদী পথ বেয়ে একানব্বইতে এসে সবাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কাছে আশ্রয় নিল। সুতরাং নতুন গণতান্ত্রিক নির্মাণে আমাদের এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষা নেওয়ার সময় আমাদের একথা মাথায় রাখা জরুরি যে আশির দশক থেকে বিশ্বায়নের অঙ্গ হিসেবে যে কাঠামোগত পুনর্গঠণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বরাকের সমাজের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশুদ্ধ কৃষকের সংখ্যা বরাকের গ্রামাঞ্চলে এখন খুবই সীমিত – কৃষকরা একাধারে শ্রমিকও। তাই ভাষা-পরিচিতির অধিকার,জনগোষ্ঠীগত অধিকার ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের প্রশ্নে আমাদের যুগপৎভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এবারের উনিশ হোক এই পর্যালোচনা শুরু করার দিন।

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন