সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তাৎপর্য 'কী করতে হবে?' – সেটাই বিচার্য

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,


(অরুণোদয়ের জন্য লিখেছেন অরূপা মহাজন)

সামের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য আমাদের সংগ্রহে এখনও আসেনি। সাদামাটাভাবে কতগুলো মন্তব্য অতি-সরলীকরণের দোষে দুষ্ট না হয়েই করা যায়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ কংগ্রেস তার গড় ভোটভিত্তি বজায় রেখেছে – অঞ্চল ভেদে কোথাও কমেছে – কোথাও বেড়েছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়ার প্রবণতা এবারও বজায় রয়েছে – তবে আরও ব্যাপক আকারে ধ্বস যে নামেনি তার মুখ্য কারণ রাভা হাসং-এর নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেসের কূটচাল দিশাহীন বিরোধীদের বিপর্যস্ত করতে পেরেছে। অনেক লুটপাট ও ভাওতাবাজির পরও পঞ্চায়েত স্তরে  গ্রামীণ মানুষের নগণ্য প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাগুলিকে বিরোধীদের দিশাহীনতার সুযোগ নিয়ে সামগ্রীকভাবে কংগ্রেস তাদের বদান্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কংগ্রেসের চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষা এবং তাদের বক্তব্যকে আম-জনতার মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জনগণের মধ্যে এমন এক ধোঁয়াশার জন্ম দেয় যে সঠিক হিসেবে প্রাপ্তির অবনমন সত্ত্বেও কংগ্রেসি শাসনে প্রাপ্তির আশাকে জিইয়ে রাখে ও চারিপার্শ্বে শূন্যতার মাঝে এই আশার বেলুনকে ফোলাতে তাদের বেগ পেতে হয় না। তথাপি কংগ্রেসের ঘাড়ে এআইইউডিএফের তপ্ত নিশ্বাসের ফলে জন্ম নেওয়া ভয়ঙ্কর বিষফোঁড়া নাছোড় গ্যাংগরিঙের রূপ পরিগ্রহ করার ভয় ঢুকেছে কংগ্রেসের অন্দরমহলে যা কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দকে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে। সামগ্রিকভাবে বিজেপি ও এজিপি উভয়েরই ভোটব্যাঙ্কে ধ্বস নেমেছে। আসামে বিজেপির মূল দূর্গ বরাক উপত্যকায় বিজেপির উত্থানের গ্রাফ এবার খাড়া নিচের দিকে নেমে গিয়ে এক বড় পতনের জন্য অপেক্ষা করছে। সামগ্রিকভাবে কংগ্রেস ভাল ফল করলেও বরাক উপত্যকায় কংগ্রেস কিন্তু আশানুরূপ ফল করেনি, বরঞ্চ এইউডিএফ বরাক উপত্যকায় কংগ্রেসের অনেকগুলি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। এবারের নির্বাচনে এইউডিএফ বরাক উপত্যকায় বাঙালি হিন্দু পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের তাৎপর্যপূর্ণ ভোট লাভে সক্ষম হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠিত দলের বাইরে ধনবল-বাহুবলের সাথে টেক্কা দিতে শুধুমাত্র সাংগঠনিক শক্তি ও লিফলেট নিয়ে ভোটারদের দোয়ারে পৌঁছে যাওয়া কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করে এবারে প্রথমবারের মত গ্রামীণ শ্রমিকের ইউনিয়ন অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন বরাক উপত্যকার তিন জেলায় ভালসংখ্যক আসনে প্রার্থী দেয় এবং যেখানে তাদের প্রার্থী নেই সেখানে এআইইউডিএফ-কে সমর্থন করে। ইউনিয়নের প্রায় সব প্রার্থী ভালসংখ্যক ভোট পেয়ে গ্রামাঞ্চলে এক নতুন শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীদের অনেকেরই বক্তব্য হচ্ছে এই যে বিগত কয়েকবছর যাবত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গ্রামীণ মানুষের আন্দোলন ইউনিয়নের প্রার্থীদের নিজেদের ভোট প্রাপ্তি যেমনি সুনিশ্চিত করেছে ঠিক তেমনি এইউডিএফের শক্তি বৃদ্ধির পেছনেও এক পরোক্ষ কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল থেকেছে। সাদামাটাভাবে নির্বাচনী ফলাফলের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে এভাবেই বলা যায়। তবে বরাক উপত্যকায় কংগ্রেসের আশানুরূপ ভোট না পাওয়া, ব্যাপকহারে বিজেপির ভোট কমে যাওয়া, এইউডিএফের ভোট ও আসন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ শ্রমিক ইউনিয়নের এক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশকে সমাজ-পরিবর্তনকামীদের ভবিষ্যত কর্মসূচী নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হবে। সর্বোপরি নির্বাচনী ইস্তাহারে এক নতুন সামাজিক-রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে ইউনিয়নের সফলতা এক বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে ইউনিয়নের এই ইস্তেহার নিচে হুবহু তুলে দেওয়া হলো।
ইউনিয়নের গ্রামীণ সমর্থন-ভিত্তি যা হয় সরাসরি ইউনিয়নের নির্বাচনী প্রার্থীর পক্ষে এসেছে অথবা কংগ্রেস-বিজেপিকে পরাস্ত করার স্বার্থে এআইইউডিএফ-এর পক্ষে গিয়েছে, তা মূলতঃ গ্রামীণ শ্রমিক – দিনমজুর, গরিব ও ভূমিহীন কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দোকানদার এবং গ্রামীণ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ, জনগোষ্ঠীগতভাবে এরা পিছিয়ে পড়া ও তপসিলি সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু মানুষ। দেখা গেছে যে যেসব পঞ্চায়েতে সমর্থন ভিত্তির সাথে সাথে ইউনিয়নের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে সেখানেই ইউনিয়ন সরাসরি ভালসংখ্যক ভোট পেয়েছে এবং অন্যত্র ইউনিয়নের সমর্থন-ভিত্তি ইউডিএফের সাথে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ যেসব পঞ্চায়েতে ইউনিয়ন ভালসংখ্যক ভোট পেয়েছে সেসব পঞ্চায়েতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরে এক সমান্তরাল গণ-ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে ভবিষ্যতে গণ্য হতে পারে যা গ্রামীণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-কাঠামোর বর্তমান চরিত্র পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করে চলবে। স্থানিক মাত্রায় চাপ সৃষ্টির এই শক্তি যদি রাজ্য ও দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের শরিক এবং একই সাথে চালিকা শক্তি হতে পারে তাহলেই পরিবর্তনের এক বাতাবরণ তৈরি হতে পারে যখন ক্ষমতা-দখল ও ক্ষমতার চরিত্র – পরিবর্তন একইসাথে যুগপতভাবে ঘটে। এই দু’টি পরস্পর সম্পৃক্ত ঘটনা বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়ার ব্যাপক জনমুখী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, নির্বাচন বহির্ভূত কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বা এই সবগুলির এক মিশ্র-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটবে কি না সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য এক পৃথক বিতর্কের সূত্রপাত করা যেতে পারে। কিন্তু একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে নিপীড়িত শ্রেণি-বর্ণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও তাকে ব্যাপক পরিসরে সঠিক মৌলিক পরিবর্তনের দিশায় পরিচালিত করতে সক্ষম সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছাড়া পরিবর্তনকামী কিছু লোকের এই ক্ষমতা – কাঠামোয় অংশগ্রহণ বর্তমান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্রের কোন পরিবর্তন সূচিত করতে সক্ষম হবে না, বরঞ্চ এই ব্যবস্থা পরিবর্তনকামী এই লোকদেরকে যারা সমাজের সবচাইতে পিছিয়ে পড়া অংশকে প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরকে আত্মস্থ করে নিতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়নের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভালসংখ্যক ভোট প্রাপ্তি নির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থীর জয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হওয়া এই শক্তি এক নতুন শ্রেণি রাজনীতির সূচনা করার শুরুয়াত হতে পারে, বিশেষ করে আজকের পরিস্থিতিতে যখন দেশব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন ও সবচাইতে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর আন্দোলন আবারও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে নির্বাচনে জিতে কিছু সংস্কারমূলক কাজ করা কী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অধিক সহায়ক হত না? আমাদের মতে এই প্রশ্নের কোন সরাসরি ইতিবাচক বা নেতিবাচক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। সংস্কারমূলক কাজ নির্বাচনে না জিতেও করা সম্ভব এবং তা ব্যাপক আকারেই করা উচিত এবং নির্বাচনী ফলাফল ইঙ্গিত করছে যে এই কাজটি অর্থাৎ গ্রামীণ মানুষের ন্যায্য অধিকারগুলি আদায় করার কাজটি এখন আরও ভালভাবে করা সম্ভব এবং সেক্ষেত্রে জয় – পরাজয়ের ফারাক খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, যদিও ইউনিয়নের অনেক প্রার্থীই জয়লাভ করেছে। তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে সংস্কারমূলক আন্দোলনের অভিমুখকেই শুধু পরিবর্তনকামী আন্দোলনের দিকে রাখলে চলবে না, পরিবর্তনকামী আন্দোলনও একইসাথে জোরেসোরে গড়ে তুলতে হবে এবং এর জন্য চাই সচেতন প্রয়াস। আশু কিছু পদক্ষেপ এই সচেতন প্রয়াসের অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। এগুলি হতে পারে নিম্ন রূপ – (১) রাজ্য ও দেশব্যাপী মেহনতি মানুষের আন্দোলনের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় গড়ে তুলতে আন্দোলনের বিষয়ের ক্রমাগত সাধারণীকরণ ও সাংগঠনিক উদ্যোগকে স্থানিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক পরিধিতে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ। (২) খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ও শ্রমিক অধিকারের আন্দোলনকে আরও জোরদার করার পাশাপাশি জনগোষ্ঠীগত অধিকারের প্রশ্নকে আরও জোরদার করা। ইউনিয়ন যদিও যুগপতভাবে এই দু’ধরনের আন্দোলনই চালিয়ে যাচ্ছে, তবে আমার মতে মেহনতি মানুষের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে যেসব মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী বা উচ্চ শ্রেণি-বর্ণের লোকেরা ইউনিয়নের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে তাদেরকে পঞ্চায়েত/ব্লক স্তরেই জনগোষ্টীগত অধিকারের আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য এক পৃথক মঞ্চে সমাবেশিত করা যাতে স্বউদ্যোগে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সাংগঠনিকভাবে তারা যুক্ত হতে পারে এবং শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন ইউনিয়নের কাজেও সহযোগিতা ও সহায়তা করতে পারে। ইউনিয়ন সংগঠন পরিচালন করার জন্য গ্রামীণ সাংগঠনিক কাঠামোয় শ্রমিক-গরিব মেহনতি মানুষ ও মহিলাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। (৩) উপরিউক্ত সবগুলি কাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন এক রাজনীতি সচেতন কর্মীবাহিনী যারা যে কোন শ্রেণি-বর্ণ থেকেই আসতে পারে, কিন্তু তাদেরকে হতে হবে শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক আদর্শে দিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতনভাবে নির্দ্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দ্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও তার ভিত্তিতে কর্মসূচী রূপায়ণের জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিনিয়ত ও জীবন্তভাবে গণ-সংগঠনের সাথে ভাবের আদানপ্রদানে আগ্রহী ও সক্ষম। ◌◌◌

দুর্নীতিমুক্ত - শক্তিশালী পঞ্চায়েত ও গ্রামসভা এবং গ্রামীণ মানুষের অধিকার সাব্যস্ত করুন।
আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের মনোনীত ও সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিন।।

আমরা সামাজিক সংগঠন হয়েও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। কেন? কারণ আমরা চাই পঞ্চায়েত হয়ে উঠুক গ্রামীণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলি চায় পঞ্চায়েতকে দালাল তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার করতে। আমরা চাই নতুন সামাজিক রাজনীতি যেখানে নির্বাচিত প্রার্থী ভোটারদের মতামত মেনে চলবে, ওরা চায় নির্বাচনের পর মুষ্টিমেয় প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী লোকের কাছে সাধারণ ভোটাররা যেন পদানত থাকে। আমরা চাই পঞ্চায়েতের হাতে অধিক ক্ষমতা – শক্তিশালী গ্রামসভা, ওরা চায় ডিআরডিএ-ব্লক ইত্যাদি মারফত মন্ত্রী-আমলাদের ক্ষমতার মাধ্যমে পঞ্চায়েতকে, ব্যবহার করে হরির লুঠ চালিয়ে যেতে। তাই আইনানুগ গেজেট নোটিফিকেশন হওয়া সত্ত্বেও ২৯টি বিভাগের ক্ষমতা পঞ্চায়েতের হাতে বাস্তবে দেওয়া হয় না – গ্রামসভাকে সুকৌশলে বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ইউনিয়ন তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় আমলাদের এই জনবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে বিগত বছরগুলিতে লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে এবং অনেকক্ষেত্রে সফলতাও লাভ করেছে। এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করছি।
বন্ধুগণ, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন আসাম তথা ভারতবর্ষে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে।   কৃষক-শ্রমিক-মহিলা-নিপীড়িত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এমনকী মধ্যবিত্ত সহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, ঠিক তেমনি আসামের জাতি-নির্মূলীকরণের ঘৃণ্য রাজনীতির বলি হচ্ছেন লাখ লাখ ধর্মীয়-ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষ। এই অস্থির পরিস্থিতির জন্য দায়ী রঙ-বেরঙের শাসক দলগুলির নীতি ও চক্রান্ত। কারণ, সরকারী জনবিরোধী নীতির ফলেই ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিগত কংগ্রেস-বিজেপির শাসনকালে আমাদের দেশের আরবপতির (একশত শতকোটি টাকার মালিক) সংখ্যা যেখানে জাপান-চীনের মত দেশের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৮০ জনের দৈনিক ব্যয় গড়ে মাত্র ২০ টাকা অর্থাৎ তাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। নিম্ন আসামের মত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের উদবাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া উচ্ছেদ হওয়া মানুষের দুরবস্থার ও হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার করুণ কাহিনী আমাদেরকে পীড়া দেয়। এরকম দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও সরকার নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছে। তাই মানুষ আজ দিকে দিকে এই অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। এই সব বিদ্রোহকে এক নতুন দিশা দেখাতে, গ্রামীণ মানুষ-শ্রমিক-কৃষক-নিপীড়িত জনগোষ্ঠী-ছাত্র-যুব ও মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক নতুন সামাজিক রাজনীতির জন্ম দিতেই অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।
বন্ধুগণ, অনেকেই আশা করেছিলেন যে অন্ততঃ ভাষিক-ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে এআইইউডিএফ দল এক সামাজিক রাজনীতির জন্ম দেবে। কিন্তু অনেকেই এখন আশাহত হতে শুরু করেছেন। অনেকেই জানেন যে নিম্ন আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসান চরের মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষিক-ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও শ্রমিক-কৃষকের এক ব্যতিক্রমী নেতা হিসেবে ‘মৌলানা ভাসানি’ নামে জনপ্রিয় ছিলেন। কৃষক-মেহনতি মানুষ-ভাষিক-ধর্মীয় সংখ্যালঘু দরদি নেতা ও নিপীড়িত মানুষের চোখের মণি মৌলানা ভাসানির বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে আপসহীন সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারা এআইইউডিএফের মধ্যে অনুপস্থিত। ধর্মীয় অনুশীলনে দরিদ্র মানুষের কাছের লোক ও জুলুম-জালিমের বিরুদ্ধে নিরলস জেহাদি মৌলানা ভাসানির গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-মেহনতি মানুষের পক্ষে নিরলস আপসহীন সংগ্রামের ফলেই কংগ্রেস সরকার তাকে বারবার জেলে পুড়ে ফেলে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে স্বরাজ্য পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করে পরবর্তীতে মৌলানা ভাসানি নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেন এবং আসামে ও তৎকালীন পাকিস্তানে শাসকদের বিরুদ্ধে এক সামাজিক-রাজনীতির জন্ম দেন। বাঙালি জাতির নিজের লড়াই নিজে লড়ার পক্ষে এবং কৃষক আন্দোলনের পক্ষে ওকালতি করায় তাঁকে এমনকী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীরও কোপের মুখে পড়তে হয়। নিম্ন আসামে সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারের জন্য মৌলানা ভাসানির আপোসহীন লড়াই’র কোন বৈশিষ্ট্যই আমরা এআইইউডিএফ দলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। ধনী-ক্ষমতাবান ও কংগ্রেসি মার্কা রাজনীতির লক্ষণ এআইইউডিএফের মধ্যে বেড়েই চলেছে। তথাপি যেসব পঞ্চায়েতে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন মনোনীত ও সমর্থিত প্রার্থী নেই, সেখানে কংগ্রেস-বিজেপি বিরোধী শক্তিশালী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
বন্ধুগণ,অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন জনজাতীয়দের তপসিলিকরণ, মুসলিম ফিসারম্যান – কিরাণ ইত্যাদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করা ও ভাষিক – ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা অনুপাতে সংরক্ষণ কার্যকরী করা ইত্যাদি দাবিতে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছে এবং এই নির্বাচনী প্রচারেও এগুলিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইউনিয়ন প্রার্থীদের জয়যুক্ত করলে এই অন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। 
বন্ধুগণ, সরকার বড় বড় দেশি-বিদেশি কোম্পানী মালিকদের যখন সরকারী অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন ধরনের ছাড় দিচ্ছে, তখন সমস্ত ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে আম-জনতার ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়েছে। বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানীদের সেবা করতে গিয়ে কংগ্রেসি সরকার খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের ছাড় দিচ্ছে যাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও বিপদাপন্ন হচ্ছে, নগদ অর্থে সাবসিডি প্রদানের প্রকল্প চালু করে কংগ্রেস সরকার আসলে একদিকে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য সাবসিডি’র পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে এবং অন্যদিকে সমাজের দুর্বল অংশ বিশেষ করে মহিলাদের ও শিশুদের বঞ্চিত করে সমাজকে পঙ্গু করে দেওয়ার নীতি নিয়েছে। তাই সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে মানুষ বিদ্রোহ করছে। এতে শাসকরা খানিকটা ভয় পেয়েছে। তাই মানুষকে সন্তুষ্ট করতে এনরেগা, খাদ্য সুরক্ষা বিল, ইন্দিরা আবাস, আইসিডিএস, মিড ডে মিল, বিভিন্ন ধরনের ভাতার মত কিছু জনমুখী প্রকল্প মানুষের সামনে হাজির করেছে সরকার। কিন্তু প্রথমত প্রয়োজনের তুলনায় এগুলি অত্যন্ত নগণ্য, দ্বিতীয়ত এমনভাবে এগুলির নিয়ম বানানো হয়েছে যে প্রকৃত দরিদ্র মানুষকে এর থেকে বঞ্চিত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে পঞ্চায়েত ও গ্রামসভাকে শক্তিশালী করে যদি গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়ন করা না হয়, তাহলে দালাল আমলা-রাজনীতিবিদরাই বরাদ্দকৃত অর্থ লুটেপুটে খাবে। সুতরাং এই পরিপ্রেক্ষিতে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও যে বিষয়গুলিকে সামনে রাখছে সেগুলি হল - (১) প্রকল্প রূপায়ণে দুর্নীতি দূর করা (২) পঞ্চায়েতের হাতে অধিক ক্ষমতা ও ওয়ার্ডভিত্তিক গ্রামসভাকে শক্তিশালী করা (৩) এনরেগায় বছরে ২০০ দিনের কাজ ও ২৪০ টাকা হাজিরা প্রদান (৪) আইসিডিএস, বিভিন্ন ধরনের ভাতা, ইন্দিরা আবাস, বিপিএল তালিকায় হিতাধিকারী নির্বাচনে গ্রামসভাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান  (৫) সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা (৬) গ্রামীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পানীয় জল ও যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত করা (৭) জমির পাট্টা ও ভূমিহীনদের ভূমি প্রদান। (৮) সাচার রিপোর্টের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের জন্য এমএসডিপি’র সঠিক রূপায়ণ সুনিশ্চিত করা ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করা।
                    

ধারাবাহিক গল্প "অহং"-এর পঞ্চম পর্বঃ ধোঁয়াশা

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

ধোঁয়াশা

(আমাদের সমকালের জন্য লিখেছেন অনীক লস্কর)

      কুলেন্দ্র ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে। ঘরের দেওয়ালের ফাকফোঁকর দিয়ে বাইরেটা দেখতে পায়। রাতের আঁধারের সাথে চাঁদের আলো মায়াবী আয়েশে যেন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। নৈঃশব্দের সাথে একটানা ঝিঁ ঝঁ পোকার শব্দ নবদম্পতির আলিঙ্গনের স্পর্শের মত একে অপরের সাথে মজে আছে। গাঁয়ের মধ্যরাতির আবেশ কুলেন্দ্র যেন নতুন করে টের পায় – কুলেন্দ্রর গায়ে শিহরণ জাগে। বাড়ি থেকে আজ রীণার দ্রুত চলে যাওয়ার দৃশ্য তার মনে পড়ে – এই প্রথমবার রীণার দেহ-সৌষ্ঠব তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রীণার প্রেমিক অর্থাৎ কুলেন্দ্রর দাদার জেল, নিজের অমতে অন্যের সাথে বিয়ে, ছেলের অকাল মৃত্যু, অসুখী দাম্পত্য জীবন ইত্যাদির জন্য রীণার প্রতি তার কোন অনুকম্পা হয় না, রীণার প্রতি তার ব্যবহার এই ধারণা নির্ভর যে রীণা ভালমানুষ। ভালমানুষ এ জন্যই যে রীণা সবকিছুকেই মানিয়ে নেয় অন্যের কথা ভেবে – নিজের ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে মানসিক যন্ত্রণাকে ভবিতব্য ভেবে সহনীয় করে তোলে। রীণা প্রতিবাদ করে না, বিদ্রোহ করে না, ফুলেন্দ্রর মত বদলা নেওয়ার কথাও ভাবে না – মেয়েলি গুণ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় কি দেয়-না সে নিয়েও রীণা সম্ভবত মাথা ঘামায় না। তাহলে রীণা কুলেন্দ্রর সাথে কী কথা বলতে চায়? ফুলেন্দ্রর সাথে দেখা করতেই বা সে কেন আসে? ভবিতব্যের বিপরীত পথ ধরে রীণার এই আনাগোনা নিয়মকে অস্বীকার করার সুপ্ত বাসনার লক্ষণ নয় তো? শহুরে শিক্ষিত আপ-রাইট মহিলা বিশ্বাসের স্ত্রীও তো কেমন যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধ পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন। সেভাবে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে রীণার সাথে বিশ্বাসের স্ত্রীর তুলনা করাটা কুলেন্দ্রর মন সায় দেয় না। বিশ্বাসের স্ত্রীকে ভাল লাগার সাথে তার একটা সমীহভাব মিশে আছে। বিশ্বাসের স্ত্রী আধুনিক মনস্কা, সবকিছু জানতে – বুঝতে চায়, নতুন কিছু নিজের উদ্যোমে করারও একটা চাহিদা আছে। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ ও কুলেন্দ্রর প্রতি তাঁর ব্যবহারই কুলেন্দ্রকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। ইউনিভার্সিটির সুস্মিতাও আধুনিক -  উচ্চশিক্ষিত – ধনবান – এরিস্ট্রোক্র্যাট পরিবারের মেয়ে। চেহারায় ও বেশভূষায় সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সুস্মিতা যখন দামি গাড়ির দরজা খুলে ইউনিভার্সিটি চত্বরে পা রাখে, এডমিনিসট্র্যাটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার সুযোগ কখনও হাতছাড়া করতে চায় না কুলেন্দ্র। কিন্তু বিশ্বাসের স্ত্রী ও সুস্মিতার মধ্যে একটা ফারাক সে মনে মনে ঠাহর করে। সুস্মিতাকে জড়িয়ে ধরার আকর্ষণ তার শরীরের রক্তপ্রবাহে ঢেউ তুলে। কুলেন্দ্র তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু সুস্মিতার মুখাবয়ব তার চোখের সামনে আবছা হয়ে যায়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আরও জোরে নাড়াচাড়া করতে থাকে – সুস্মিতাকে সে কোনভাবেই দেখতে পায় না। সুস্মিতা তার কাছে অধরাই থেকে যায় – সে নেতিয়ে পড়ে – নির্জীব অবস্থায় কখন যে আবার ঘুমের আবেশে নিমজ্জিত হয় তা বলতেই পারে না। এবারে ঘুমের তাপে তার আর স্বপ্ন ফুটে না।        

              ঘুম যখন ভাঙে, তখন বাড়ির উঠোনে কড়া রোদ এসে পড়েছে। সামনের রাস্তা দিয়ে পাশের গাঁয়ের আমিনূরের সুমো গাড়ির ইঞ্জিনের গড়গড় আওয়াজে ভেসে আসছে। আমিনূর কুলেন্দ্রর স্কুলের বন্ধু। গেল বছর প্রাইভেট ফিনান্সের লোনের গাড়ি লাইনে ছেড়েছে ভাড়া খাটানোর জন্য। লোন নেওয়ার জন্য নগদ জমার অর্থ জোগাড় করেছে দু’খানি পাম্পসেটের অপারেটর হিসেবে পাওয়া কমিশন জমা রেখে এবং একটি ইন্দিরা আবাসের অর্থ দিয়ে। আমিনূরের গ্রামের জমিদার পরিবারের সাদিক চৌধুরী অবিসি কৃষক সমিতির নামে বরাদ্দকৃত এই পাম্পসেট দু’টি আমিনূরের জিম্মায় রেখে খেতের মরসুমে ভাড়া খাটান। তালিকা থেকে অন্যের নাম বাদ দিয়ে ইন্দিরা আবাসের নগদ অর্থও পাইয়ে দিয়েছেন সাদিক। আমিনূররা তা জানে। কিন্তু তথাপিও আমিনূররা চৌধুরীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। চরিত্রগতভাবে আমিনূর ও কুলেন্দ্র বিপরীত মেরুর। স্কুলে কুলেন্দ্র শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক – আর আমিনূর গাট্টাগোট্টা খারাপ খাসলতের ছেলে হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যেই বন্ধুত্ব জমে উঠে – সে এক অন্য রহস্য। আমিনূর তার মনের কথা কুলেন্দ্রকে বলত। কুলেন্দ্রর মনে পড়ে আমিনূর একদিন বলেছিল, তার আব্বা কেন চৌধুরীদের নিয়ে গালি পাড়েন তা সে বুঝতে পারে না। তার আব্বা নাকি বলেন “আল্লায় সাহারা দিলে চৌধুরীর লুঙি তুইল্যা হুগা দিয়া বাঙ হারাই দিতাম”। তার আব্বার কাছ থেকেই সে শুনেছে এই চৌধুরীরাই তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আর এখানে থাকার জায়গা দিয়েছেন – তথাপি চৌধুরীদের উপর তার আব্বার কেন এত গোসা আমিনূর বুঝে উঠতে পারে না। চৌধুরীদের দৌলতেই তো সে এখন গাড়ির মালিক। তবে পাম্পসেটের ভাড়ার টাকা সময়মত দিতে না পারলে যখন জাত তুইল্যা গাল পাড়ে তখন তারও আব্বার মত গোসা ওঠে। আমিনূর খুব গর্ব করে তার ঠাকুর্দার বীরগাঁথা কুলেন্দ্রকে শোনাত – কুলেন্দ্ররও তা শুনতে ভাল লাগত। মন দিয়ে আমিনূরের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা শুনত বলেই বোধহয় কুলেন্দ্রই ছিল আমিনূরের সবচাইতে প্রিয় বন্ধু। আমিনূরের ভয়ে স্কুলে কুলেন্দ্রকে কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। আমিনূরের বাপের বাপ অর্থাৎ দাদাজান ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের নানকার প্রজা হিসেবে হদ-বেগার। মোট বওয়া – পালকি টানা ইত্যাদি যে কোন গতরখাটা কাজের লাগি জমিদার যখনই হুকুম দিত, তখনই তার দাদাজানকে তাঁর ছোট পোলা অর্থাৎ আমিনূরের বাপরে নিয়া জমিদারের দোয়ারে হাজির হতে হত। হুকুম তালিমে একটু এদিক-ওদিক হলে কিল-লাথি জুটত। তার ঠাকুর্দার মূল দায়িত্ব ছিল জমিদারের লাঠিয়ালের কাজ করা। জমিদারির খাসতালুকে সামান্য জমি খেতি করে সংসারের সবার পেটের নান জোগাড় করতে হত, আর বিনিময়ে হদ-বেগারি গতর খেটে জমির কর দিতে হত।

           এসব কথা ভাবতে ভাবতে কুলেন্দ্রর স্কুলের স্মৃতি মনে হল। দু’জনে স্কুল পালিয়ে করিমগঞ্জ শহরে মর্নিং শো সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে কুলেন্দ্রর। বলিউডের হিন্দি সিনেমার নায়ক এক কৃষক পরিবারের ছেলে – জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমিদারকে মেরে পালিয়ে যায়। কমার্সিয়্যাল সিনেমার সমস্ত মশালা সহ বাগী নায়কের নেতৃত্বে কৃষক যোদ্ধাদের বাহিনী ও জমিদারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার মধ্য দিয়ে সিনেমার প্লট এগিয়ে চলে। অনর্গল কথা বলা আমিনূরের স্বভাব। যে সিনেমা দু’জনে মিলে দেখল, হল থেকে বেরিয়েই সেই সিনেমার পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্প আবার কুলেন্দ্রকে এমনভাবে বলতে লাগল – যেন কুলেন্দ্র নায়কের বীরত্ব যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে পায়ে পায়ে দু’জনে কুশিয়ারার পাড়ে এসে পড়ল। আমিনূর একটি কাঠের লগে কুলেন্দ্রকে বসতে বলে সিনেমার কাহিনীর সূত্র ধরে তার দাদাজানের কাহিনী বলতে আরম্ভ করল।

           সিলেট ধর্মপাশার খাজনা-আদায়কারী আজাদ তালুকদার আমিনূরের দাদাজান সহ অন্যান্য নানকারদের বড়-জমিদারের বাড়িতে হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠায়। রোজগারের আশায় সুযোগ পেলেই তারা অন্যত্র কাজের সন্ধানে যায়, সেদিন তারা ভোরবেলা শহরে গিয়েছিল। সকালে ঘুরে এসে জানতে পারে যে তাদের যেতে দেরি হওয়ায় এক কৃষক রমণীকে জমিদারের খাস লোকেরা জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। জমিদার রণেন্দ্র চরণ চৌধুরীর সৌখীনতা ও কামুকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনূর এক সায়র শোনায় – “চৌধরী ছিল রণেন্দ্রচরণ রসিয়া নাগর, জল টাঙ্গনের ঘরে শোয় দোসরা নাগর”।

         কথা বলতে বলতে আমিনূরের উত্তেজনা বাড়তে থাকে, “হুন, আমার দাদাজানর বউত গুরদা আছিল, সবরে কইল - চল, আমরা ওগুর কোন কাজ করতাম নায়, আর আমরার ইজ্জত বাচাইতে বেটিরে ছুটাইয়া আনতে লাগব। আমার দাদাজানর কথায় সব অউ রাজি অইল। জমিদারর দাওয়াত গিয়া আজিলে – জমিদার রাগে গড়গড় কইর‍্যা আগাইয়া আইতে আইতে কইল, “তরার তো সাহস কম নায়, একলগে আইয়া আমার দাওয়াত মাথা তুইল্যা দাড়াইচছ”। দাদাজানের কিছু একটা কওয়ার ধরলেই, জমিদার যেই তার উফরে হাত উঠাইছে, অমনি হাতর লাঠি দিয়া জমিদারর মাথাত বওয়াই দিল। জমিদার মাটিত পড়ি গেছে – রক্ত বারই গেছে। চারদিক থাইক্যা ধর মার আওয়াজ। দাদাজান ইখান থাইক্যা ভাগল। দাদাজানর পরিবারের সবরে কয়দিন আজাদ তালুকদার লুকাইয়া রাখছিল এবং পরে ন-আবাদি বিলর জমিদার চৌধরীর ইখান নানকার কইর‍্যা পাঠাই দিল। ওউ জমিদারিতও পরে গণ্ডগোল লাগায় অউ জমিদারর কুটুম তাঁর মসির ঘরর ভাই রসিদ চৌধরীর আব্বার জাগাত আইয়্যা ঠেক বানাইছইন আমার দাদাজান যেখান অখন আমরা আছি, আব্বার কাছ থাইক্যা হুনছি ঔ জিল্লাতও চৌধরী জমিদারর বিরুদ্ধে নানকার হকলে বউত লড়াই লড়ছইন – তখন থাইক্যাউ আব্বার গোসা কীনা জানি না”। সাদিক চৌধুরীদের এখন আর জমিজমা তেমন নেই – ভিটেমাটি ও কয়েক কিয়ার নিজস্ব ক্ষেতের জমি ছাড়া বাকি সব বিক্রি করে দিয়েছে। সাদিকরা পাঁচ ভাই – এক ভাই থানার দারোগা, একজন হাকিম, একজন উকিল ও আরেক ভাই বিডিও’র চাকরির সুবাদে গ্রামের বাইরে নিজের নিজের সংসার নিয়ে থাকেন। সাদিক গৃহস্থি সামলান ও গ্রামের মাতব্বর হিসেবে পঞ্চায়েত প্রধানও তাকে সমীহ করে চলে – স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সাথে তার দহরম-মহরম রয়েছে। সরকারী সুযোগ সুবিধা কে কীভাবে পাবে বা ব্যবহার হবে সেব্যপারে সাদিক চৌধুরীর মতকে সব ক্ষেত্রে সবাই গুরুত্ব দেয়। সবাইর ধারণা সাদিক চৌধুরী সবক্ষেত্রেই বিবেচকের মত সিদ্ধান্ত নেন। একমাত্র আমিনূরের আব্বাই ব্যতিক্রম। আমিনূরের মাঝে মাঝে মনে হয় তার আব্বা নিমখহারামি করছেন। গোসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তার আব্বা তেলে-বেগুনে জ্বলে     ওঠেন – আমিনূরের সাথে এব্যাপারে কোন কথা বলতে চান না। আমিনূর কিন্তু সাদিক চৌধুরীর দৌলতেই বেশ কিছু অর্থ কামিয়েছে, তাই সাদিক জাত তুলে গালি পাড়লে তার পিত্ত জ্বললেও সে তা হজম      করে নেয়।  

            গল্প বলার উত্তেজনায় দু’জনেই পেটের খিদা ভুলে ছিল – এক্ষণে পেটে মোচড় দিয়ে তা জানান দেয়। পাশের ঝুপটি দোকানে দু’জনে মিলে পেটপূর্তি ঘুঘনি দিয়ে হলুদ-ভাতের পোলাও খায় ও তারপর গরুর দুধের চা খেয়ে আমিনূর একটা বিড়ি ধরায়। বেলা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল – সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এবার বাড়ি ফেরার তাড়া – স্কুল ছুটির সময়ের আগেই বাড়িতে পৌঁছতে হবে। লাইনের সুমো গাড়িতে চেপে দু’জনে গৃহাভিমুখে রওয়ানা দেয়। আমিনূরের বাড়ির সামনে পৌঁছতেই অনেক লোকের জটলা দেখা যায় ও বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল ভেসে আসে। আমিনূর বুঝতে পারে দাদাজান আর বেঁচে নেই – বেশ কিছুদিন বিছানায় কাটিয়ে প্রায় শতবছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়ে তার গর্বের দাদাজান আজ ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন।

             এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে গেছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। মিনিট-সেকেণ্ড-ঘণ্টা দিয়ে সময়ের হিসেব আর ভাবনার সময়ের হিসেবের মধ্যে এক বৈপরিত্য রয়েছে। বর্তমান যখন মস্তিষ্কের উপর চেপে বসে তখন সে ভাবনাকে সময়ের পেছন দিকে যেতে প্ররোচিত করে। ভবিষ্যত কল্পনার বাস্তবভিত্তি সময়ের উভয়মুখী আনাগোনার মধ্য দিয়ে একে একে রূপ নিতে থাকে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের হিসেবের সময় বড়ই নির্মমভাবে একমুখীন। শৈশবের স্মৃতি কুলেন্দ্রকে এখন তাড়া করলেও শৈশব তো আর ফিরে আসবে না। কুলেন্দ্রর এই অলস সকালের কয়েক ঘন্টা সময়ের মধ্যেই তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকটি মটর-সাইকেলে তার গাঁয়ের বন্ধুরা বেড়িয়ে গেল – দু’চারটে বড় গাড়িও লাইনের ট্রিপ ধরতে বেরিয়ে পড়েছে। হাইওয়েতে যাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে কুলেন্দ্রর বাড়ির পাশ দিয়ে গুপ্ত বাড়ির পেছন দিয়ে সোজা একটা নতুন রাস্তা হওয়ায় আজকাল এই সুবিধে হয়েছে। এই রাস্তা বানানোর কাজেও কুলেন্দ্রর বন্ধুরা ছোটোখাটো উপ-ঠিকাদারি পেয়েছিল। বলাই-মদন-আমিনূররা বেরিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলে গেছে – “হই কুলেন্দ্র, আজকে আছচ তো, বিকালে দেখা অইব”। এদের মধ্যে কেউ ঠিকাদারের এজেন্ট, কেউ স্কুলে মাস্টার, কারুর বাজারে কম্প্যুটার-ইন্টারনেটের দোকান রয়েছে। কুলেন্দ্রর বাবা গাঁয়ের ফসল কিনে সাপ্তাহিক হাট-বাজারে ঠেলা দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মোটামুটি একটা কামাই করতেন – কুলেন্দ্রর বাবার মত গাঁয়ের অনেকেই সাইকেল-ঠেলায় বিভিন্ন ধরনের মাল বয়ে নিয়ে সাপ্তাহিক হাট-বাজারের ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকত। এখন সে ব্যবসা থেকে আর মুনাফা আসে না। চালানি মালের সাথে টেক্কা দিয়ে আর লাভ করা যায় না। কুলেন্দ্রর বাবার আয় এখন আর প্রায় নেই, বয়সের ভারেও ন্যুব্জ। ফুলেন্দ্রর আয়ে সংসার চলত – সেটাও এখন বন্ধ। হঠাৎ মস্তিষ্কে হাজির হওয়া এই দুশ্চিন্তায় তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে।

             নিজের অজান্তেই পায়ে পায়ে কখন যে উঠোনের একপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। হঠাৎ বাড়ির গেটের সামনে এসে একটা গাড়ি থামলে সে সম্বিত ফিরে পায়। মারুতি-৮০০ গাড়ি থেকে প্রথমেই যাকে সে নামতে দেখে তাতে তার নিঃশ্বাসের গতি তীব্র হতে থাকে। গাড়ি থেকে প্রথমেই নামেন বিশ্বাসের স্ত্রী এবং তারপর একে একে জিতেন বিশ্বাস ও আরেকজন অপরিচিত ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয় – গেটের সামনে গিয়ে কুলেন্দ্র জিজ্ঞেস করে “আরে, আফনারা যে!” এর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই তাঁরা ততক্ষণে কুলেন্দ্রর বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়েছেন। কুলেন্দ্র ঘরের ভেতর আসার ইঙ্গিত করলে জিতেন বিশ্বাস উঠোনে বসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন – কুলেন্দ্র সে অনুযায়ী বসার জায়গা করে দেয়। বিশ্বাসের স্ত্রীই প্রথমে কথা পাড়েন, “আমরা এসেছি একটা প্রজেক্ট নিয়ে - ও আরে, আগে তো তোমার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দেই – ইনি হচ্ছেন প্রজেশ কর, শিলচরে থাকেন – ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের ছাত্র নেতা – এখন আমাদের এনজিও করেন”। প্রজেশ করকে কুলেন্দ্রর খুব চেনা চেনা লাগছে – কোথায় যেন দেখেছে। কুলেন্দ্রর কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে প্রজেশ কর বলে ওঠেন – আমি এঅঞ্চলে আগে অনেকবার এসেছি। বিশ্বাসের স্ত্রী বলতে থাকেন, “আমরা একটা প্রজেক্ট নিয়ে এসেছি – আপনি যদি এঅঞ্চলে আমাদের কাজ করেন – তাহলে একটা মাসমাইনে দেব ......।” কুলেন্দ্রর যেন বিশ্বাসের স্ত্রীকে অপরিচিত ঠেকে – কেন জানিনা তার রীণার কথা আবার মনে পড়ে – রীণা তো এরকম স্বার্থপর নয়, না স্বার্থ কী বস্তু রীণা বুঝেই না। সেই তূল্যমূল্য বিচারে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে – ওরা কী কথা বলছে তার কর্ণগোচর হয় না। হঠাৎ বাইরে রাস্তায় অনেক লোকের হৈ-হট্টগোল ও চিৎকারের আওয়াজ শুনে সে দৌড়ে বেরিয়ে দেখে, পাগলা শংকর লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলছে  “কত লোক মারিয়াছি এই খাণ্ডা দিয়া, আপনি মরিব আজি দেখ দাড়াইয়া”, আর সবাই তাকে জাপটে ধরে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। শংকরকে আগে কখনও এরকম উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক হতে দেখেনি। কুলেন্দ্র তাড়াতাড়ি সবাইকে জোর করে সরিয়ে দিতেই, শংকরের লাঠির আঘাত তার কাঁধ ও মাথায় এসে পড়ে। কুলেন্দ্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, চেতনা হারাতে হারেতে সে শংকরের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। চেতন থেকে অচেতনের যাত্রায় পরিচিত – অপরিচিতের ব্যবধান ধীরে ধীরে কুলেন্দ্রর মস্তিষ্কে ধোঁয়াটে হয়ে আসে।         

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন